অর্থনীতির খবর : করোনা মহামারীর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ছোট ব্যবসায়ীদের স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল চলতি বছরের শুরুতে। কথা ছিল ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান (এমএফআই) বা বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) মাধ্যমে ৪ শতাংশ সুদে এ ঋণ দেয়া হবে। এজন্য ১০ হাজার কোটি টাকার তহবিল ঘোষণার কথাও বলা হয়।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের মতামত চাইলে তারা সাফ জানিয়ে দেয়, বাজেট থেকে এ অর্থ দেয়া সম্ভব না। ফলে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায় প্যাকেজটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ। এমন পরিস্থিতিতে গত মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থায়নে এ তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, প্যাকেজের আওতায় ১০ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ পাবেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা।
গত ১৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থায়নে এ প্যাকেজ ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়। এরই মধ্যে এ-সংক্রান্ত একটি খসড়া নীতিমালা অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব মৃত্যুঞ্জয় সাহা বণিক বার্তাকে জানান, তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের খসড়া নীতিমালাটি চূড়ান্ত করে গত ৩১ মার্চ অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিবের কাছে পাঠিয়েছেন। অর্থ বিভাগ এটিতে অনুমোদন দিলেই বাংলাদেশ ব্যাংক এ প্রণোদনা প্যাকেজটি প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, প্রান্তিক পর্যায়ে উদ্যোক্তা তৈরি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দ্রুত দারিদ্র্য নিরসন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কুটির, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র (সিএমএস) শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এছাড়া ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান বা এনজিওগুলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ব্যাংকিং সেবাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে অর্থায়নসহ বিভিন্ন সামাজিক সেবা দিচ্ছে, যা আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে ও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে তাত্পর্যপূর্ণ। ক্ষুদ্রঋণের গ্রাহকের পাশাপাশি নভেল করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) প্রাদুর্ভাবের কারণে গ্রামীণ অর্থনীতিতে কুটির, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র শিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের অর্থায়নের চাহিদা বেড়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে তফসিলি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের সংযোগের মাধ্যমে কুটির, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র শিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন সরবরাহ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার একটি আবর্তনশীল পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন করা হয়েছে।
১০ হাজার কোটি টাকার এ প্যাকেজ থেকে বাংলাদেশে কার্যরত সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা গ্রহণ করবে। তবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক ছাড়া যেসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের বেশি, সেসব ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান এ স্কিমের আওতায় অর্থায়নকারী ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যোগ্য বিবেচিত হবে না। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পাওয়া অর্থ এনজিওগুলো বিতরণ করবে। তবে এক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রক সংস্থার সনদপ্রাপ্ত যে এনজিওগুলো আছে তারাই কুটির, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র শিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণ দেবে। তাই এনজিওগুলোকে অর্থায়নে তফসিলি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে একটি অংশগ্রহণমূলক চুক্তি করতে হবে।
খসড়া নীতিমালায় বলা হয়, এনজিওগুলো গ্রাহকদের সর্বোচ্চ বার্ষিক ৮ শতাংশ সুদে ঋণ দেবে। এর মধ্যে গ্রাহক পরিশোধ করবে ৪ শতাংশ। বাকি ৪ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে দেবে। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান এনজিওগুলোকে অর্থায়নের বিপরীতে কোনো সুদ বা সার্ভিস চার্জ আদায় করতে পারবে না। তবে সরকার তাদের ১ শতাংশ হারে সুদ ভর্তুকি দেবে। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে পুনঃঅর্থায়নের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকও কোনো সুদ বা সার্ভিস চার্জ আদায় করবে না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককেও সরকার শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ সুদ ভর্তুকি হিসেবে দেবে।
এ প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণের মেয়াদ গ্রাহকের ব্যবসার ধরন ও টার্নওভার অনুযায়ী নির্ধারণ করা হবে। তবে গ্রাহক পর্যায়ে ছয় মাসের গ্রেস পিরিয়ডসহ ঋণ পরিশোধের সর্বোচ্চ মেয়াদ হবে দুই বছর। গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের পরিমাণের ক্ষেত্রে বলা হয়, কুটির শিল্পের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ঋণের পরিমাণ হবে ১০ লাখ টাকা, মাইক্রো শিল্পের ক্ষেত্রে ৩০ লাখ ও ক্ষুদ্র শিল্প বা ব্যবসায় সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা। কোনো গ্রাহক কেবল এ তিনটির একটি শ্রেণীতে ঋণ সুবিধা পাবেন। গ্রুপভিত্তিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও এ প্যাকেজ থেকে ঋণ নিতে পারবে। গ্রুপভিত্তিক অর্থায়নের ক্ষেত্রে গ্রুপের সদস্য সংখ্যা হবে ন্যূনতম পাঁচজন।
গ্রাহক পর্যায়ে প্যাকেজের ৪০ শতাংশ ট্রেডিং খাতে ও ৬০ শতাংশ উৎপাদন ও সেবা খাতে বিতরণ করতে হবে। নির্বাচিত গ্রাহকদের কাছ থেকে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো ভর্তি ফি, পাস বই, ঋণ ফরম ও নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে অঙ্গীকারনামার খরচ ছাড়া ঋণের বিপরীতে অন্য কোনো চার্জ আদায় করতে পারবে না।
খসড়ায় আরো বলা হয়, ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রক সংস্থার ইস্যু করা আর্থিক সক্ষমতা বিষয়ক প্রত্যয়নপত্রের ভিত্তিতে ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বা এনজিওগুলো তাদের বিদ্যমান ঋণ বা বিনিয়োগ স্থিতির সর্বোচ্চ ১০ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ এ প্যাকেজের আওতায় ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নিতে পারবে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রত্যয়নপত্র প্রদানের অনুরোধের তিন কার্যদিবসের মধ্যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এনজিওর ঋণ প্রাপ্তির সক্ষমতা বিষয়ক প্রত্যয়নপত্র সরবরাহ করবে। প্রত্যয়নপত্র দেয়ার ক্ষেত্রে এমআরএ এনজিওগুলোর দায় (সঞ্চয়, গৃহীত কার্য) ও সম্পদের (ঋণ বা বিনিয়োগ স্থিতি) অনুপাত, সার্ভিস চার্জ আয় ও বেতন-ভাতার অনুপাত, ব্যাংক ও অন্যান্য উৎস থেকে গৃহীত ঋণ নিয়মিত ফেরত প্রদান ও মোট উদ্বৃত্ত তহবিলের ১০ শতাংশ দ্বারা সংরক্ষিত তহবিল গঠনের বিষয়গুলো বিবেচনা করবে।
এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে গত বছর ২৩টি প্যাকেজের মাধ্যমে ১ লাখ ২৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকার ঋণ, নগদ অর্থ ও খাদ্যসহায়তার ঘোষণা করেছিল সরকার। এর মধ্যে মাইক্রো ও কুটির শিল্পসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তাদের খাতে চলতি মূলধন দেয়ার জন্য বরাদ্দ ২০ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের ১৩ এপ্রিল শুরু হওয়া এ প্যাকেজ থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১২ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। বাকি আছে ৭ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। দেশের ৭৬টি ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ৯ শতাংশ সুদে এ ঋণ দিচ্ছে। এক্ষেত্রে গ্রাহককে সুদ দিতে হবে ৪ শতাংশ আরা বাকি ৫ শতাংশ সরকার সুদ ভর্তুকি হিসেবে দেবে।