রাজনীতির খবর : সংসদীয় আসন ঢাকা-১৮ এর উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ার জন্য মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছিলেন ৫৬ জন। ব্যাপারটি দেশের ইতিহাসে সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। ওয়ার্ড থানার নেতা, গার্মেন্ট মালিকসহ অনেক অচেনা মুখও ছিলেন নৌকা প্রতীকের প্রত্যাশায়। দলের দুঃসময়ে মাঠে না থাকলেও এমপি প্রার্থী হতে মরিয়া ছিলেন এসব নেতা। ‘অমুক’ ভাইকে এমপি পদে দেখতে চাই এমন প্রচারণায় ফেসবুকে সোচ্চার ছিলেন তাদের নিজ নিজ সমর্থকরা। শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচনই নয়, উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন তো বটেই বিভিন্ন হাটবাজার সমিতির নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে নেতা-কর্মীদের যেন ঢল নামে। তৃণমূলের বিভিন্ন নির্বাচনে তো প্রার্থীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয় কেন্দ্রকে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী কিংবা আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আত্মপ্রচারে সরব থাকেন রাত-দিন। তাদের কর্মী-সমর্থকরাও ‘ভাই’ কী করল, ‘ভাবি’ কোথায় মার্কেট করল সেগুলোও নিজেদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানান দেন।
আর জন্মদিন কিংবা বিয়েবার্ষিকী হলে তো কথাই নেই। শুভেচ্ছাবার্তায় ভরে যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর নিউজ ফিড। কিন্তু হেফাজতের তান্ডব ও তাদের নানা অপপ্রচারের বিরুদ্ধে মাঠে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতাদের তৎপরতা তেমন দেখা যায়নি গত কয়েক দিনে। অর্থাৎ যখন আওয়ামী লীগ নেতাদের সরবতা প্রয়োজন সে সময়ে তারা নীরব থাকছেন। আর যখন প্রয়োজন নেই তখন নিজের আত্মপ্রচার, নিজের পদ-পদবি থেকে উচ্চ পদের নেতাদের নিয়ে তেলবাজিতে সরব থাকছেন।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২৬ মার্চ বাংলাদেশে দুই দিনের সফরে আসেন। এই সফর ঘিরে ২৩ মার্চ শুক্রবার থেকে হেফাজতে ইসলাম তান্ডব চালানো শুরু করে। শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করে তারা ঢাকায় বিক্ষোভ করে। এ সময় সংঘাতের ঘটনা ঘটে। এর প্রতিবাদে ওই দিন বিকালে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে হামলা-ভাঙচুর চালায় হাটহাজারী মাদরাসার ছাত্ররা। সেখানে সংঘর্ষের ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটে। এর প্রতিবাদ জানাতে ওই দিন বিকালেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রাস্তায় নামেন হেফাজত কর্মীরা। তারা রেলস্টেশনে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং শহরে ব্যাপক তান্ডব চালায়। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হয় একজন। রেলস্টেশন, সরকারি অফিসসহ বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন দেয়।
গত ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে একটি রিসোর্টে নারীসহ স্থানীয় জনতার হাতে আটক হন হেফাজত নেতা মাওলানা মামুনুল হক। এ ঘটনায় হেফাজতের নেতা-কর্মীরা তান্ডব চালিয়ে মামুনুলকে ছিনিয়ে নেয়। এরপর ওই নারী ও মামুনুলের ফোনালাপ ফাঁস হয়। বিভিন্ন টেলিভিশন ও পত্র-পত্রিকায় তা গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হলেও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, সরকারের মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতা-কর্মীই দর্শকের ভূমিকায় ছিলেন। আবার যারা পদ-পদবিতে নেই সেই নেতারা, বিশেষ করে সাবেক ছাত্রনেতাদের একটি বিশেষ অংশ ব্যাপক সরব ছিল। গতকাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ৮১ সদস্যের মধ্যে প্রায় ২৫ জন নেতার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ সংক্রান্ত কোনো পোস্ট চোখে পড়েনি। অর্থাৎ সময়ে নীরব থাকছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। আর অসময়ে সরব হয়ে উঠছেন। একইভাবে হেফাজতের আস্ফালন নিয়ে সরকারের একজন উপমন্ত্রী দীর্ঘদিন ধরেই কড়া অবস্থানে ছিলেন। কিন্তু অন্য মন্ত্রী বা দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ‘দেখা যাক পরিস্থিতি কোন দিকে যায়’ পর্যবেক্ষণে ছিলেন।
গত রবিবার সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন হেফাজতের তান্ডব নিয়ে বক্তৃতা করেন, তারপর কিছু নেতা ও মন্ত্রী হেফাজতের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চেয়ে টেলিভিশন কিংবা অনলাইন পত্রিকায় সাক্ষাৎ বা বিবৃতি দিয়েছেন। ‘আইডিতে রিপোর্ট’ করে ডিজএবল করে দেবে এই ভয়ে তারা নীরব ভূমিকায় রয়েছেন বলে একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। অন্যদিকে ছাত্রলীগ-যুবলীগের অনেক নেতা-কর্মী হেফাজতের কর্মকান্ড সমর্থন করে নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে সমর্থন দিয়েছেন। এ জন্য কয়েকজনকে ইতিমধ্যে পদচ্যুত করা হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের নেতারা কিংবা মন্ত্রিসভার সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর দিকে চেয়ে থাকেন। প্রধানমন্ত্রী কোনো ইস্যুতে কঠোর অবস্থান নিলে তখন তারা ঝাঁপিয়ে পড়েন। তার আগে কেউ কিছু বলেন না। তারা এও বলছেন, সব যদি একজন ব্যক্তিকেই করতে হয় তাহলে এত বড় মন্ত্রিসভা কিংবা দলের এত বড় কমিটি রেখে লাভ কী? শুধু আওয়ামী লীগই নয়, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, তাঁতী লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, মৎস্যজীবী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সম্মেলনের হাজার হাজার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা রয়েছেন। জেলা-মহানগর, উপজেলায় পৃথক পৃথক কমিটি রয়েছে। কেউ হেফাজতের তান্ডব, ফোনালাপ ফাঁস, কিংবা হেফাজত আওয়ামী লীগকে নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে, সেসবের জবাব দিচ্ছেন না। যারা দলীয় পদ-পদবিতে নেই শুধু তারাই সোচ্চার হয়েছেন। আবার একটা সময় আওয়ামী লীগের সাইবার যোদ্ধা হিসেবে যারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন, তাদের অনেকেই ফেসবুকে নীরব। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের একটি উপ-কমিটির উদ্যোগে কয়েক লাখ সাইবার যোদ্ধা সৃষ্টি করার ঘোষণা দিলেও সেটার কোনো প্রতিফলন হেফাজতের তান্ডবের সময় চোখে পড়েনি।
সূত্রমতে, ঢাকা-৫ আসনের উপনির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিল দেড় ডজন। হেফাজতের ‘কারখানা’ খ্যাত যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদ এবং ডেমরা এলাকায় উপনির্বাচনে প্রার্থী হতে দৌড়ে যেসব প্রার্থী ছিলেন তারাও হেফাজতের তান্ডবের সময় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহস দেখাননি। সঠিক নেতৃত্ব না থাকায় যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদ, সাইনবোর্ড, শনির আখড়ায় ব্যাপক তান্ডব চালিয়েছে হেফাজত। এই সময়ে হেফাজতের নেতাদের নানা অপকর্ম যখন বের হচ্ছে, তখন আওয়ামী লীগ নেতা-মন্ত্রীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নীরব থাকা নিয়ে খোদ দলের ভিতরে-বাইরেই নানামুখী প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সাবেক ছাত্রনেতারা রাগে-ক্ষোভে নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখছেন, এখনই চেনার উপযুক্ত সময় ‘সীমিত পরিসরে’ কারা আওয়ামী লীগ করছে। তারা আরও লিখছেন, দলের কেন্দ্রীয় নেতা কিংবা মন্ত্রীদের কাছে হাইব্রিডদের ধাক্কায় যাওয়া যায় না। ‘তেলবাজ’ নব্য লীগাররা ‘ভাই লীগ’ নিয়ে যত সক্রিয় সরকারের উন্নয়ন প্রচার কিংবা অপপ্রচারের জবাব দিতে ততটা নন।