জাতীয়

সুন্দরী দিয়ে ভয়ঙ্কর প্রতারণার ফাঁদ, ‘সাংবাদিক’-‘পুলিশ’ সবই আছে

By Daily Satkhira

April 11, 2021

বস্ত্র করে ছবি তুলে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে সর্বস্ব

একদিনে ২ ভুক্তভোগীর মামলা

পুলিশের বরখাস্ত এক এসআইসহ গ্রেপ্তার ৬ 

‘সাংবাদিক’-‘পুলিশ’ সবই আছে

অনলাইন ডেস্ক : অভিযু্ক্ত উপপুলিশ পরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান ওরফে আছাদ। মাদক সেবনের দায়ে সম্প্রতি তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। পল্লবীর মামলায় গ্রেপ্তার এই পুলিশ কর্মকর্তা সর্বশেষ পল্লবী থানায় কর্মরত ছিলেন। আর ডানে রূপনগরে গ্রেপ্তার মো. শহিদুল ইসলাম।

এ যেন এক নাটকই বটে। সব দিক ভেবে লেখা হয় সেই নাটকের দৃশ্যপট। কুশীলবও সেভাবেই প্রস্তুত থাকে। নাটকের প্রয়োজনে কেউ করেন পুলিশের অভিনয়, কেউবা সাংবাদিকের। প্রপস, কস্টিউমসও যেমনটা হলে যুৎসই হয়, তেমন করেই প্রস্তুত থাকে। সেই নাটক জমিয়ে তোলেন এক সুন্দরী নারী। এসব কুশীলব চিত্রায়িত নাটকে একজন হন ভুক্তভোগী। তবে তিনি নাটকের ভুক্তভোগী নন, বাস্তবেই।

রাজধানীর মিরপুর বিভাগের কয়েকটি থানা এলাকায় সুন্দরী নারী দিয়ে এমন ভয়ঙ্কর প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে একাধিক প্রতারক চক্র। সর্বশেষ পুলিশের মিরপুর বিভাগের পল্লবী ও রূপনগর থানা এলাকায় সুন্দরী নারী দিয়ে প্রতারক চক্রের ব্লাকমেইলিংয়ের শিকার হয়ে সর্বস্ব খুইয়েছেন দুজন। গত শুক্রবার পল্লবী ও রূপনগর থানায় প্রতারক দুই চক্রের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন ভুক্তভোগী পদ্মা ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. তারিকুল ইসলাম খান ও মিরপুর ডিওএইচএস কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেমস লিমিটেডের কর্মকর্তা মো. ফয়সাল।

পৃথক ঘটনায় প্রতারক চক্রের নারী-পুরুষ ৬ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন সম্প্রতি মাদক (হেরোইন) সেবনের দায়ে বরখাস্তকৃত উপপুলিশ পরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান ওরফে আছাদ, জয়নাল, মেহেদী, আদনান, মো. শহিদুল ইসলাম ও মোসা. জারিয়া রহমান ওরফে সাথী আক্তার। পুলিশ তাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন, এটিএম কার্ড ও স্ট্যাম্প জব্দ করেছে।

প্রকৃত বিষয় হচ্ছে, ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য যারা, সাংবাদিক বা পুলিশকর্তা যা-ই হোক- তারা সবাই একটি চক্রের সদস্য। সবার উদ্দেশ্য একটাই- ব্ল্যাকমেইলিং। টার্গেট তাদের ধনাঢ্য ব্যক্তি, বড় ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী কিংবা রাজনীতিবিদ। পুলিশ ও সাংবাদিকের বেশভূষা- সবই আছে তাদের কাছে। ব্লাকমেইলিংয়ের নাটক সাজাতে এসব চক্রের পুরুষ সদস্যরা পরিস্থিতি বুঝে কেউ বনে যায় সাংবাদিক, কেউ পুলিশ কর্মকর্তা।

আর নারী সদস্যরা কখনো প্রেমের ফাঁদে ফেলে, কখনো সময় কাটানোর নামে টার্গেট করা ব্যক্তিকে ডেকে নিয়ে আসছেন তাদের নির্ধারিত আলিশান ফ্ল্যাটে। তার পর ভিকটিমকে বিবস্ত্র করে তার পাশে চক্রের নারী সদস্যদের বিবস্ত্র অবস্থায় রেখে তোলা হচ্ছে ছবি; কেড়ে নেওয়া হচ্ছে সর্বস্ব।

এখানেই শেষ নয়। বিবস্ত্র সেই ছবি কখনো ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে, কখনো পত্রিকায় ছাপানোর কথা বলে কখনো-বা নারী নির্যাতন মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে ভুক্তভোগীর কাছ থেকে দফায় দফায় হাতিয়ে নিচ্ছে তারা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। গোপনে ধারণ করা ভিডিও প্রতারক চক্রের কাছে থাকায় অধিকাংশ ভুক্তভোগী পরিবার ও সামাজিক মর্যাদার ভয়ে প্রতারকদের কাছে নিঃস্ব হয়েও মুখ খুলছেন না। অভিযোগ, এসব চক্রের সদস্যদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে অসাধু কিছু পুলিশ সদস্য, কথিত সাংবাদিক, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং পুলিশের সোর্স।

শনিবার (১০ এপ্রিল) ওই ৬ জনকে আদালতে পাঠিয়ে তাদের রিমান্ড আবেদন করেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। গ্রেপ্তার এসআই আছাদুজ্জামান সর্বশেষ পল্লবী থানায় কর্মরত ছিলেন। পল্লবী থানার মামলায় অভিযুক্ত আখি ওরফে সাথী, বাবু ও কল্লোল আর রূপনগর থানার মামলার আসামি বাবু পলাতক বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।

পল্লবী থানায় দায়ের করা মামলায় পদ্মা ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট তারিকুল ইসলাম উল্লেখ করেন, ব্যাংকের ঋণ খেলাপিদের অবস্থান শনাক্ত করে তাদের আইনের আওতায় আনতে প্রায়ই তিনি গোপনে মাঠপর্যায়ে তদন্ত করতে যান। এরই ধারাবাহিকতায় গত বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টার দিকে তিনি পল্লবী থানাধীন সেকশন-১১, পলাশনগর এলাকায় মালিক সমিতির মোড়ে জনৈক এ সাব্বির হাসান নামে ঋণ খেলাপির সম্পর্কে গোপন তদন্তে যান।

সে দিন বিকাল ৪টার দিকে পল্লবীর সেকশন-১১, পলাশনগর এলাকায় ৫০/৫/এ নম্বর মো. জাহাঙ্গীর আলমের বাসায় গিয়ে সাব্বির হাসানের কথা জানতে চাইলে অচেনা এক ব্যক্তি তাকে জানান, সাব্বির হাসান বাসার বাইরে আছেন, কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে এবং তাকে ওই বাসার নিচতলার একটি কক্ষে বসতে দেন। বিকাল সোয়া ৪টার দিকে প্রতারক চক্রের সদস্য ২০ বছর বয়সী আখিসহ অচেনা ৬ জন ফ্ল্যাটে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে তাকে এলোপাতাড়িভাবে মারধর করে।

একপর্যায়ে তারা তারিকুল ইসলামের কাছে ২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন এবং তার সঙ্গে থাকা বিভিন্ন ব্যাংকের ডেবিট, ক্রেডিট ও মাস্টারকার্ড ছিনিয়ে নিতে চায়। এ সময় বাধা দিলে আসামিদের একজন তার গলা টিপে হত্যার চেষ্টা করে, অন্যজন তার পকেট থেকে ২ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। এ সময় তারিকুল ইসলাম আসামিদের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইলে প্রতারকরা তার শার্ট, প্যান্ট খুলে একটি গামছা পরিয়ে তাকে ধারালো অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে আখিকে তার পাশে বসিয়ে বেশ কিছু আপত্তিকর ছবি তোলে ও ভিডিও করে। তাদের দাবিকৃত ২ লাখ টাকা চাঁদা না দিলে তাকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে তার বিভিন্ন ব্যাংকের ডেবিট, ক্রেডিট ও মাস্টারকার্ড এবং কার্ডগুলোর পিন নম্বর নিয়ে নেয়।

তারিকুল ইসলাম আরও জানান, কার্ডগুলো নিয়ে ৪ জন বাইরে চলে যায় এবং তার কাছে আখিকে বসিয়ে ২ জনকে পাহারাদার হিসেবে রেখে যায়। পরে তার কার্ডগুলো দিয়ে ব্যাংকের বুথ থেকে এবং বিভিন্ন শপিংমল থেকে ৭ লাখ ১০ হাজার টাকা নগদ উত্তোলন ও শপিং করে। রাত সাড়ে ৮টার দিকে অচেনা ৪ জন ফিরে এসে মুক্তি দেয় তারিকুল ইসলামকে।

এ সময়, ঘটনার বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে তাদের মোবাইলে ধারণকৃত তারিকুল ইসলামের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিবে বলেও হুমকি দেয়। তাদের জিম্মিদশা থেকে ছাড়া পেয়ে তারিকুল ইসলাম গাড়ির ড্রাইভার সিরাজের সহায়তায় স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা গ্রহণ করেন বলেও মামলায় উল্লেখ করেন।

এ বিষয়ে পল্লবী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবু সাঈদ আল মামুন বলেন, ভুক্তভোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে ঘটনায় জড়িত ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে শনিবার আদালতে পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে বরখাস্তকৃত একজন পুলিশ সদস্য রয়েছেন। চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

মিরপুর ডিওএইচএস কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেমস লিমিটেডের কর্মকর্তা ভুক্তভোগী ফয়সাল রূপনগর থানায় দায়েরকৃত মামলায় উল্লেখ করেন, তিনি মিরপুরের পীরেরবাগ এলাকায় সপরিবারে থাকেন। প্রতারক চক্রের সদস্য জারিয়া রহমানের সঙ্গে ২ মাস আগে ফেসবুকের মাধ্যমে তার পরিচয় হয়। পরে জারিয়ার সঙ্গে তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ হয়। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে ফয়সালের সঙ্গে দেখা করবে বলে জানায় জারিয়া।

তরুণীর কথামতো তিনি রূপনগর আবাসিক এলাকায় ১৬ নম্বর রোডের ১৪ নম্বর ভবনের ৭ম তলায় জারিয়ার বাসায় দেখা করতে যান ফয়সাল। এ সময় ফয়সালকে একটি কক্ষে বসতে দেওয়া হয়। এর কয়েক মিনিট পরই অভিযুক্ত শহিদুল ইসলাম ও বাবু ওই কক্ষে ঢুকেই দরজা আটকে ফয়সালকে বেধড়ক পেটাতে শুরু করে। একপর্যায়ে গামছা ও কোমরের বেল্ট দিয়ে তার হাত এবং ইলেকট্রিক তার দিয়ে পা বেঁধে সঙ্গে থাকা এটিএম কার্ড ছিনিয়ে নেয়। প্রাণ বাঁচাতে প্রতারকদের কাছে কার্ডগুলোর পাসওয়ার্ড বলে দেন ফয়সাল। পরে আসামিরা বুথ থেকে তার কার্ড ব্যবহার করে ৬২ হাজার টাকা তুলে নেয়। পকেটে থাকা ১২’শ টাকা ছাড়াও ছিনিয়ে নেয় তার দুটি মোবাইল ফোন। তার পর ফয়সালের বিকাশ নম্বর থেকে ৪ হাজার টাকা তুলে নেয় চক্রের সদস্যরা।

তিনি আরো জানান, একপর্যায়ে চক্রের সদস্যরা ফয়সালকে তার পরিবার থেকে আরও টাকা আনার জন্য চাপ দেয়। টাকা দিতে না পারায় তারা ফয়সালের কাছ থেকে ১০০ টাকার মূল্যে তিনটি নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পের সাদা পাতায় স্বাক্ষর রেখে তবেই তাকে মুক্তি দেয়। এ সময় ঘটনার বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে প্রাণনাশেরও হুমকি দেয় প্রতারক চক্রের সদস্যরা।

রূপনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ বলেন, ভুক্তভোগী ফয়সালের অভিযোগের ভিত্তিতে শহিদুল ইসলাম ও জারিয়া রহমান নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করে শনিবার আদালতে পাঠানো হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছেন, চক্রের নারী সদস্যকে ব্যবহার করে তাদের পাশে টার্গেট ব্যক্তিকে বিবস্ত্র করে বসিয়ে-শুইয়ে ছবি তুলে রাখে চক্রের অন্য সদস্যরা। পরে সেই ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয়

দেখিয়ে ভিকটিমের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। ফয়সালের সঙ্গেও একই কায়দায় ব্ল্যাকমেইল করে তারা। দীর্ঘদিন ধরেই এ অপকর্ম করে আসছিল চক্রটি। তাদের অন্য সদস্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে বলেও পুলিশের এ কর্মকর্তা জানান। সূত্র: আমাদের সময়