গত এক সপ্তাহের লোডশেডিংয়ে জনজীবনের নেমে চরম দুর্ভোগ নেমে এসেছে। প্রচণ্ড গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লোডশেডিং। এতে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে। এ নিয়ে লেখালেখি চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অথচ বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বলছে, দেশের কোথাও কোনও লোডশেডিং নেই। লোডশেডিংয়ের পরিমাণ শূন্য। বিষয়টি নিয়ে সোমবার জরুরি বৈঠকে বসে বিদ্যুৎ বিভাগ। বৈঠকে পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) আবুল বাশার খান বলেন, ‘বিতরণ সীমাবদ্ধতা ও কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে।’ এছাড়া গ্যাসের স্বল্পতাকে উৎপাদন কম হওয়ার জন্য দায়ী করেন তিনি। তার এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি—ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) প্রতিনিধিরা। তাদের দাবি, উৎপাদন স্বল্পতার কারণে লোডশেডিং হচ্ছে। বৈঠক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বৈঠকে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, বিদ্যুৎ সচিব ড. আহমেদ কায়কাউসসহ বিদ্যুৎ বিভাগ, পিডিবি ও বিতরণ কোম্পানির প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু ঢাকা বা আশেপাশের অঞ্চলগুলোয় নয়, সারাদেশেই অসহনীয় লোডশেডিং চলছে। আর গরম বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় জনদুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। দেশের প্রত্যান্ত অঞ্চলেও চলছে ব্যাপক লোডশেডিং। দিনের ২৪ ঘণ্টায় মাত্র ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। বাকি সময় অন্ধকারে থাকতে হয়।
জানতে চাইলে ডিপিডিসির পরিচালক (অপারেশন) হারুন অর রশীদ বলেন, ‘গত কয়েকদিনের ঝড়ে ডিপিডিসি বিদ্যুৎ বিতরণের তার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এগুলো সংরক্ষণের কাজ চলছে। শিগগিরই সব ঠিক হয়ে যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘রবিবার কিছুটা লোডশেডিং ছিল।’
উল্লেখ্য, চলতি মাসের ২ তারিখে কালবৈশাখী ঝড়ে জাতীয় গ্রিডের একটি অংশের সঞ্চালন লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই লাইন মেরামত করতে গেলে আরেকটি লাইন বিকল হয়ে দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৩৫টি জেলা দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎহীন ছিল। ওই গ্রিড লাইন-বিপর্যয়ের পর ৩৬টি জেলায় বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। যা এখনও অব্যাহত আছে। পুরোপুরি বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করা যায়নি।
এদিকে লোডশেডিংয়ের কারণে সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে আনুষ্ঠানিক দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘অল্প সময়ের মধ্যেই বিদ্যুৎ সরবররাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।’
পিডিবির ওয়েবসাইটে কোনও লোডশেডিং নাই! এদিকে সারাদেশে যখন লোডশেডিংয়ে মানুষ অতিষ্ঠ, তখন পিডিবির ওয়েব সাইট বলছে, সারাদেশে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ শূন্য। রবিবার রাত আটটার সময় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ওয়েবসাইটে বিদ্যুৎ উৎপাদন সংক্রান্ত তথ্যে দেখা যায়, বিদ্যুতের চাহিদা আট হাজার ৮০০ মেগাওয়াট । উৎপাদনও আট হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। এই হিসাব অনুযায়ী চাহিদা ও সরবরাহ সমান। অর্থাৎ দেশের কোথাও কোনও লোডশেডিং নেই।’
এদিকে, সোমবারের বৈঠকে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন বলেন, ‘রবিবার আরইবির চাহিদা ছিল ৫ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট কিন্তু সরবরাহ পেয়েছে ৩ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। এতে স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুতের লোডশেডিং করতে হয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুত জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘আগামী চার দিনের মধ্যে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হবে। টাওয়ার ভেঙে যাওয়া, ১০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণে থাকা ও গ্যাসের স্বল্পতার জন্য চাহিদামতো বিদ্যুৎ দেওয়া যাচ্ছে না। চার দিনের মধ্যে রক্ষণাবেক্ষণে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসবে।’ রমজানে বিদ্যুৎ সরবরাহ ভালো থাকবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা উচিত। লোড ম্যানেজমেন্টে লোড শেডিং সমানুপাতিক হারে করতে হবে। প্রতিটি বিতরণ সংস্থার ডিম্যান্ড অনুসারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা প্রয়োজন। লোড শেডিং করতে হলে আগেই গ্রাহকদের জনাতে হবে।’ রোজার সময় সার্বিক পরিস্থিতি উন্নত করতে সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করাসহ মন্ত্রণালয় থেকে পর্যবেক্ষণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান।
এদিকে, বিদ্যুৎ সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণরত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পর্যবেক্ষণ করার জন্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শেখ ফয়েজুল আমীন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া এলএনডিসি বিতরণ সংস্থাগুলোকে কিভাবে, কী পরিমাণ বিদ্যুৎ দিচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণ করতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যুগ্ম সচিব এ কে এম হুমায়ুন কবীরকে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে যে ১০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে সেগুলো হচ্ছে, মেঘনাঘাট- ৪৫০ মেগাওয়াট, সামিট বিবিয়ানা-৩৪১ মেগাওয়াট, খুলনা সিপিপি-৭২ মেগাওয়াট, সিরাজগঞ্জ-২১০ মেগাওয়াট, আশুগঞ্জ সাউথ ৩৬০ মেগাওয়াট, আশুগঞ্জ-৭৫ মেগাওয়াট, ঘোড়াশাল-১ এ ৪০ মেগাওয়াট, ঘোড়াশাল-৫ এ ১৯০ মেগাওয়াট, শান্তাহার পিকিং ৫০ মেগাওয়াট এবং হাটহাজারি পিকিং ৯৮ মেগাওয়াট।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এই ১০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকায় এক হাজার ৮৮৬ মেগাওয়াট উৎপাদন কম হচ্ছে। এছাড়া গ্যাসের স্বল্পতার কারণে আরও ৮৯৩ মেগাওয়াট উৎপাদন কম হচ্ছে।