নিজস্ব প্রতিবেদক: ‘হয় মামলা তুলবি, আর না হয় তোকেই তুলে নিয়ে যাবো ’ মোবাইল ফোনে এই হুমকির কথা জানিয়ে বাবা সংবাদ সম্মেলন করার দুদিনের মাথায় তার মেয়ে শ্যামনগরের নারী চিকিৎসক শম্পারানীর বিরুদ্ধে অসামাজিক কাজের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। পরে থানা থেকেই ছেড়ে দেওয়া হয় ডা. শম্পাকে। আলোচিত এই ঘটনা নিয়ে সাতক্ষীরা এখন তোলপাড়। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে এসব নিয়ে তৈরি নানা কাহিনি। তবে শ্যামনগর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ( আরএমও ) ডা. শম্পা রানী বলেন তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। একই দাবি তারা বাবারও। অপরদিকে বিএমএর সাতক্ষীরা জেলা শাখা শম্পাকে নিয়ে এসব ঘটনার প্রতিবাদ করেছে। বিএমএ বলছে সবই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। তবে শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ( ওসি) এনামুল হক দাবি করেন, ডা. শম্পা ও আরিফুজ্জামান পলাশকে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে আটক করা হয়। পরে রাতেই মুচলেকা নিয়ে তাদের দুজনকেই ছেড়ে দেওয়া হয়। এখানে ষড়যন্ত্রের কিছু নেই। ডাক্তার শম্পার অভিযোগ, তিনি গত ২১জানুয়ারি মেডিকেল অফিসার থেকে আরএমও পদে উন্নীত হবার দিন থেকেই শুরু এই ষড়যন্ত্র। সেদিন ছাত্রলীগ তার বিরুদ্ধে মিছিল করেছিল। এরপর থেকে কোনো রোগীর চিকিৎসা দিলেই তা নিয়ে একটি মহল নানা প্রশ্নবাণ ছুড়তে শুরু করে। ওই চক্রটি কারণে অকারণে হাসপাতালে এসে অশালীন কথাবার্তাও বলে। এমনকি পত্র পত্রিকায় খবর বানানোর হুমকিও দেয় কেউ কেউ। তারাই আবার ফেসবুকে দেওয়ার নামে আর্থিক সুবিধা নিতে চায়। তিনি বলেন বারবার এধরনের ঘটনাকে মোকাবেলা করতে হয়। সর্বশেষ ঘটনার উল্লেখ করে তিনি দাবি করেন, গত ২৮ আগস্ট হাসপাতালে ভর্তি হয় তাহেরা নামের চার বছরের একটি শিশু। পেটের নাড়ি জড়ানো (ইনটেসটিনাল অবস্ট্রাকশন) এই রোগীকে কর্তব্যরত মেডিকেল অফিসার ডা. দীপংকর মন্ডল প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেন। ঘণ্টা দুয়েক পর তার অবস্থার অবনতি হতে থাকায় তাকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাবার পরামর্শ দেন ডাক্তার। এরই মধ্যে এক্সরে করানো হয় তার। এর পরপরই মারা যায় শিশুটি। তিনি বলেন এই চিকিৎসার সাথে তার এতোটুকু সংশ্লিষ্টতা ছিল না। রোগীটির মৃত্যুর পর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অফিসার ( ইউএইচএ) ডা. হাবিবের নির্দেশে তিনি তাহেরার ডেথ সার্টিফিকেট লিখছিলেন। এ সময় ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন চেনা অচেনা নেতা কর্মী ডা. শম্পার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে কিল চড় ঘুষি মেরে ও মারপিট করে কাপড়চোপড় টানা হেঁচড়া করে। এ অবস্থায় একজন নারী হিসাবে খুবই লজ্জাজনক অবস্থায় পড়েন তিনি। কর্তৃপক্ষের পরামর্শে তিনি শ্যামনগর থানায় একটি মামলা করেন। অপরদিকে মৃত শিশু তাহেরার বাবা গোলাম মোস্তফাকে দিয়ে ডা. শম্পার বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করার চাপ দিতে থাকে মহলটি। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ছিলেন। জানা গেছে শম্পার দেওয়া মামলায় পুলিশ গ্রেফতার করে কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জয় মন্ডলকে। এ সময় বিএমএ দাবি তোলে অন্যদের গ্রেফতার না করলে তারা কর্মসূচি দেবেন। পুলিশ কৌশল অবলম্বন করে হামলার মূল নায়ক শ্যামনগর মহসিন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুস সবুর ও তার সহযোগী রহমতকে গ্রেফতার করে। শম্পা বলেন তার যোগদানের দিন থেকে কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী কখনও মিছিল, কখনও হামলা ও কখনও নানা অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে ছাত্রলীগ নেতাদের গ্রেফতারের ঘটনায় শ্যামনগরে ফের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ধুমায়িত হতে থাকে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে তৎপর হয় মহল বিশেষ। ডা. শম্পার বাবা জানান, তার কাছে ও তার মেয়ের কাছে টেলিফোনে হুমকি আসে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য। না হলে ডা. শম্পাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে, তার শ্লীলতাহানি ঘটানো হবে। হুমকি আসে হত্যারও। এ ব্যাপারে থানায় একটি জিডি করা হয়। তাছাড়া শম্পার বাবা নগেন্দ্রনাথ সংবাদ সম্মেলন করে ঘটনাবলীর প্রতিবাদ করেন ও প্রশাসনের সহযোগিতা চান। এর মাত্র দুদিনের মাথায় ঘটে আরেক ষড়যন্ত্র। ডা. শম্পার বাবা বৃদ্ধ নগেন্দ্র নাথ সরদার বলেন তার মেয়ে খুলনা থেকে ফেরেন ১১ সেপ্টেম্বর রাতে। এ সময় খবর আসে তার বিরুদ্ধে শিশু তাহেরা হত্যার মামলা হয়েছে থানায়। রাতেই পুলিশ তাকে গ্রেফতার করবে। শম্পা জানান এতে তিনি আতংকিত হয়ে পড়েন। শেষে তার বাবার পরামর্শ মতো নিজের কোয়ার্টারে না থেকে কিংবা গ্রামের বাড়িতে না যেয়ে এক সহকর্মীর বাড়িতে রাত্রি যাপনের সিদ্ধান্ত নেন। ঈদের ছুটিতে যাওয়ায় ফাঁকা সরকারি কোয়ার্টারে থাকা নিরাপদ নয় বলেও মনে করেন তারা। তিনি জানান সহকর্মী ডা. আরিফুজ্জামান পলাশ শম্পাকে তার বাসায় রেখে তার স্ত্রীসহ ছেলে ও শাশুড়িকে নিয়ে পাশে দাওয়াত খেতে যান। ফিরবার সময় অপরিচিত কয়েকজন লোক পলাশের স্ত্রী শারমিন আক্তার সুইটি ও তার ছেলেকে রাস্তায় আটকে দিয়ে তার মোবাইল কেড়ে নিয়ে আছাড় মেরে ভেঙ্গে ফেলে। এরই মধ্যে ডা. পলাশও বাসায় পৌঁছে যান। তার পিছে পিছে শ্যামনগর থানার ওসি এনামুল হক বেশ কিছু লোকজনকে নিয়ে সেই বাসায় আসেন। শম্পা জানান এ সময় ‘আমি পাশের একটি কক্ষে পড়াশুনা করছিলাম। পলাশের কক্ষে পুলিশ এসে ডা. পলাশকে দিয়ে তাকে ডেকে পাঠান। শম্পা জানান, ‘এরপর ওসি আমাকে নানা প্রশ্ন করেন। তিনি বলেন আপনাকে থানায় যেতে হবে। সে অনুযায়ী চেঞ্জ করতে রুমে ঢুকি। সেখানেও নানাভাবে আমাকে হেনস্থা করা হয়। এরপর ওসি তাকে বাধ্য করান পলাশের সাথে থেকে ছুবি তুলাতে। পরে সে সব ছবি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ফেসবুকে’। থানায় নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে প্রশ্ন করা হয় তাকে ও ডা. পলাশকে। কিন্তু অসামাজিক আচরণের কোনো প্রমাণ মিলাতে ব্যর্থ হয় পুলিশ। ততক্ষণে পলাশের স্ত্রীও চলে আসেন থানায় । তিনি এঘটনার প্রতিবাদ করে বলেন এসবই ষড়যন্ত্র। অসামাজিক কার্যকলাপের কোনো প্রশ্নই ওঠে না বলে দাবি করেছেন তিনি। সাতক্ষীরা জেলা বিএমএ (বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন) এর সভাপতি ডা. আজিজুর রহমান বলেন ‘ডা. শম্পা পুরোপুরি ষড়যন্ত্রের শিকার’। তিনি এর প্রতিকার দাবি করেছেন। ডা. শম্পা তাকে নিয়ে এসব ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে এর প্রতিকার দাবি করেছেন।