ফিচার

সাতক্ষীরার গ্রামে গ্রামে করোনার উপসর্গ তবুও পরীক্ষায় অনীহা

By Daily Satkhira

June 11, 2021

নিজস্ব প্রতিবেদক : সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলার সোনাবাড়ীয়া ইউনিয়নের নাদিম মাহমুদ (৪৫)। তিনি করোনার উপসর্গ নিয়ে বাড়িতে আছেন। কিন্তু নমুনা পরীক্ষা করাবেন না। তাঁর স্ত্রী, ছোটভাই, বৃদ্ধ চাচার জ্বর এবং কাশি রয়েছে। কিন্তু তারা কেউই করোনার নমুনা পরীক্ষা করাতে রাজি নন।

কেন নমুনা পরীক্ষা করাবে না, তার কারণ খুঁজতে জানা গেল ‘সামাজিকতার ভয়’। নাদিমের বড় ভাই রফিকুল ইসলাম। তিনি জানালেন, যদি করোনার নমুনা পরীক্ষা করানো হয় এবং রিপোর্ট পজিটিভ আসে; তাহলে মানুষ উল্টা-পাল্টা ভাববে। তাদের নিয়ে বাজে মন্তব্য করবে। আর রিপোর্ট পজিটিভ এলেই হাসপাতালে নিয়ে যাবে বলে তাদের ধারণা। সেজন্য তারা কেউ নমুনা পরীক্ষা করাবে না।

নাদিমের কথার সত্যতা পাওয়া গেল আরেকটি ঘটনায়। একই ইউনিয়নের বেলী গ্রামের আল নজিব মাহফুজ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর মাহফুজের বাড়ি লকডাউন করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু লকডাউন করার পর স্থানীয় মানুষজন মাহফুজদের বাড়ির প্রতি বিরূপ মনোভাব দেখাচ্ছে। বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মানুষজন নাক টিপে ধরে চলাচল করছে। একজন মন্তব্য করে বসলেন, ‘মাহফুজকে হয় হাসপাতালে রেখে আসুক, না হলে বাড়ি থেকে বের করে দিক!’

সোনাবাড়ীয়া ইউনিয়নের আক্কাস আলী (৬২) গত কয়েকদিন শ্বাসকষ্টে ভুগে বৃহস্পতিবার সকালে মারা যান। কিন্তু করোনার নমুনা পরীক্ষা করেননি তিনি। তাঁর বাড়ির আরও চার সদস্যের শরীরে করোনার নানা উপসর্গ বিদ্যমান। অথচ, তারাও কেউ নমুনা পরীক্ষা করাতে রাজি নয়।

আক্কাস আলীর চাচাত ভাই বলেন, তিনি করোনায় মারা যাননি। তাঁর জ্বর ছিল, কিন্তু করোনা হয়নি। হার্টের সমস্যা ছিল ভাইয়ের।

মানুষের মনোভাব এমন যেন করোনায় আক্রান্ত হওয়া এক ধরনের অপরাধ। আর এই মনোভাব বাড়িয়ে দিচ্ছে করোনার বিস্তার। পরীক্ষা না করার ফলে একজন থেকে আরেকজন করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে এখন জ্বর, কাশি আর সর্দিসহ নানা উপসর্গ। অথচ দু-একজন ছাড়া কেউ নমুনা পরীক্ষা করাতে চাচ্ছেন না। যে দু-একজন পরীক্ষা করছেন, তারা সচেতন মানুষ। কিন্তু এই সংখ্যা খুবই নগণ্য।

কলারোয়া উপজেলার সীমান্তবর্তী চন্দনপুর ইউনিয়নের হোসেন আলীর পরিবারের সবাই জ্বর ও কাশিতে আক্রান্ত। হোসেন আলীর ছেলে মো. ইব্রাহিম করোনার নমুনা পরীক্ষা করাতে চাইলেও বাবা-মা কেউ পরীক্ষা করাতে দিতে যাননি। অথচ হোসেন আলীর বাড়ির পাশে আরও অনেক পরিবারেই করোনার উপসর্গ রয়েছে।

ইব্রাহিম বলেন, ‘আমাকে সবাই নিষেধ করেছে পরীক্ষা করাতে। পুলিশ এসে নাকি তুলে নিয়ে হাসপাতালে ফেলে রাখবে! সেজন্য আমার আব্বা-আম্মা যেতে দেয়নি।’

এদিকে করোনা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় সাতক্ষীরাতে লকডাউন করে দেওয়া হয়েছে। যদিও লকডাউনের মধ্যে গ্রামের ভেতর কিংবা শহরে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। বাজার-ঘাটে কিংবা গ্রামের ভেতর খুব বেশি মানুষকে মাস্ক পরতে দেখা যাচ্ছে না। পুলিশের উপস্থিতি দেখলে সবাই মাস্ক ব্যবহার করছেন, অন্য সময় খুলে রাখছেন।

মহিদুল ইসলাম নামের একজন বলেন, ‘এত সময় মাস্ক পরে থাকা যায় না, কষ্ট হয়। মনে হয় মুখে ঠুসি (গরুর মুখের ঠুসি) দিয়েছি। আর চারিদিকে যে জ্বর, এটা সিজনাল। ঠিক হয়ে যাবে। এত ভাবার কিছু নেই। তারপরও করোনা হলে মরব আর কী হবে?’

করোনার উপসর্গ ও পরীক্ষা না করার বিষয়ে আরও কয়েকজনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। পরীক্ষা করলে সামাজিক সমস্যাসহ আরও নানা সমস্যা হবে বলে তাদের দাবি।

এদের মধ্যে সজীব নামের একজন বলেন, করোনা পজিটিভ হওয়ার পর বাড়ি লকডাউন করে দিলে বিপদ। এ ছাড়া হাসপাতালে না কোথায় নিয়ে রাখবে তাও জানি না। দেখা গেল মরার সময়ও পরিবারের কেউ দেখতে পেল না। তাহলে ওই মরা মরে লাভ কী? আর বাইরে বের হতে না দিলে খাব কী? সমিতির টাকা দিব কীভাবে? মাঠে জন (কামলা) না দিলে সমিতির টাকা দেবে কে? আল্লাহ যদি চান, তাহলে আমি এমনিতেই মরব। এত ভেবে লাভ নেই।’ একই ধরনের মনোভাব আছে আরও অনেকের।

এসব বিষয়ে সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা. হুসাইন সাফায়েত বলেন, ‘এখানকার মানুষ ভীষণ অসচেতন। এদেরকে বোঝালেও বোঝে না। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ বেশি অসচেতন। কেউ নমুনা পরীক্ষা করাতে চায় না। সেজন্য এখন গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে করোনা ছড়িয়ে গেছে বলে আমাদের মনে হচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ খুব কঠিন হবে আমাদের জন্য।’

মানুষ নমুনা পরীক্ষা করাতে চাচ্ছে না, তাহলে উপায় কী- এমন প্রশ্নে হুসাইন সাফায়েত বলেন, ‘আমরা ধরেই নিয়েছি সবাই করোনায় আক্রান্ত। এখন সবাইকে টেস্ট করে সরকারি রিসোর্স নষ্ট করে লাভ নেই। বরং কীভাবে পিউর লকডাউন করে মানুষকে ঘরবন্দি করা যায়, সেদিকে আমাদের লক্ষ্য দিতে হবে। সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত মানুষ চলাচল করছে, দোকানপাট খোলা থাকছে; এই সময়টা কমিয়ে আনতে হবে। আমরা সেসব ব্যাপারে মিটিং করে প্রাথমিকভাবে কথাবার্তা পাকা করেছি। তবে এটাও ঠিক এই পরিস্থিতিতে পুরোপুরি লকডাউন করার পর সরকারের এত জনবল নেই সবকিছু সুন্দরভাবে মনিটরিং করার। কিছু সমস্যা তো হবেই। এর ভেতর দিয়েও আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।’

কলারোয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান লালটু ইসলাম বলেন, ‘প্রায় বাড়িতে সবার জ্বর। প্রতিদিন পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলছে আক্রান্তের হার। আমার ধারণা, সাধারণ মানুষ লজ্জা, ভয় ও লকডাউনের যাতাকলে কেউ পরতে চায় না। যে কারণে কেউ করোনা টেস্ট করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আর লকডাউন করেই আমাদের (উপজেলা প্রশসন) দায়িত্ব শেষ। তার চিকিৎসা, খাওয়া-দাওয়া ও পরিবারের অন্য সদস্যদের শারীরিক অবস্থা দেখার কেউ নেই। লকডাউন মানে সমাজে বা পাড়ায় একঘরে হয়ে থাকা। কেউই তার সাহায্য তো দূরের কথা নাক টিপে তার বাড়ি পার হচ্ছে। এ কথা লজ্জায় অন্যকে বলতে পারে না। কী পরিস্থিতি সামনে আসছে, আল্লাহ জানে।’