রাজনীতির খবর : হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল থাকলেও তার লিভার ও কিডনি প্রায় অর্ধেক কার্যক্ষমতা হারিয়েছে। তার মেডিকেল বোর্ডের শেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, করোনা-পরবর্তী জটিলতায় ফুসফুস, হার্ট, লিভার ও কিডনি শরীরের এই চারটি অঙ্গই আক্রান্ত হয়েছে। এমন পিরিস্থিতিতে চিকিৎসকরা প্রয়োজনে তার লিভার ট্রান্সপ্লানন্টেশনের (প্রতিস্থাপন) সুপারিশ করেছেন। এ ছাড়া তার ডাক্তারদের শঙ্কা হৃদরোগের কারণে খালেদা জিয়ার শরীরের যেকোনো একটি চেম্বার বা অংশের মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
সূত্র জানায়, এসব জটিল সমস্যার আগাম উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আধুনিক প্রযুক্তিযুক্ত হাসপাতালে স্থানান্তরের জোর সুপারিশ করেছে মেডিকেল বোর্ড। মেডিকেল প্রতিবেদনে কোনো দেশের নাম উল্লেখ না করলেও এ ধরনের উন্নত চিকিৎসা দেশে সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে। ভবিষ্যৎ চিকিৎসা পরিচালনার জন্য বোর্ড সুপারিশ করেছে যে, রোগীকে এমন একটি উচ্চতর কেন্দ্রে স্থানান্তর করা উচিত, যেখানে মাল্টিসিস্টেম ডিজিজ ম্যানেজমেন্টের জন্য অগ্রিম সুবিধা পাওয়া যায়।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ডা. এফ এম সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন ১০ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড খালেদা জিয়ার শারীরিক সমস্যা চিহ্নিত করে পাঁচ দফা পরামর্শ বা সুপারিশ করেছে।
পাঁচ দফা সুপারিশে যা বলা হয়েছে- ১. ক্রনিক লিভার ডিজিজ (লিভার সিরোসিস) কোন পর্যায়ে রয়েছে তা পরীক্ষা করে খাদ্যনালির কোন জায়গা থেকে (ডিআই ব্লিডিং) হচ্ছে সেটি বের করতে বলা হয়েছে। প্রয়োজনে লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশনও লাগতে পারে।
২. কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে খালেদার শরীর প্রোটিন ধরে রাখতে পারছে না। প্রস্র্রাবের সঙ্গে অনেক প্রোটিন বের হয়ে যায়। এ জন্য তাঁর আধুনিক উচ্চ চিকিৎসার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ ক্রনিক লিভার ডিজিজ পরিস্থিতিকে আরো জটিল করেছে।
৩. হৃদরোগের জটিলতার কারণে যেকোনো সময় তার হৃদরোগের বেদনায় বিশেষ একটি চেম্বার বা অংশে মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। তার হার্টের স্পন্দন মাঝেমধ্যেই অনিয়মিত হয়ে পড়ে এবং এটি যেকোনো সময় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
৪. রিউমাটয়েড আথ্রাইটিসের কারণে খালেদা জিয়ার বিভিন্ন জয়েন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার কারণে অন্যের সাহায্য ছাড়া তিনি দৈনন্দিন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারেন না। এটা ক্রনিক লিভার ডিজিজ ও ক্রনিক কিডনি ডিজিজের কারণে।
৫. সবশেষে খালেদা জিয়ার পারিবারিক রোগের ইতিহাস পর্যালোচনা করে চিকিৎসকরা তার রোগের যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন চিকিৎসার ব্যবস্থা করা জরুরি বলে মনে করেন।
চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হার্টের জটিলতায় খালেদা জিয়ার এনজিওগ্রাম করা সহ তাৎক্ষণিকভাবে তাকে রিং পরানোর প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের চিকিৎসকদের অনেকেই সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি নিতে চাইবেন না। তাঁর রক্ত যাতে জমাট না বাঁধে সে জন্য প্রচুর ওষুধ ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া তাকে চার ব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছে।
ডাক্তাররা জানান, কারাগারে এবং করোনায় বাসায় আটকে থাকার কারণে গত চার বছরে নিয়মিত চেকআপ না হওয়ার কারণে খালেদা জিয়ার লিভার ও কিডনি আগে থেকেই দুর্বল অবস্থায় ছিল, যা করোনা-পরবর্তী জটিলতায় প্রকট আকার ধারণ করেছে।
পর্যালোচনায় ডাক্তারা জানান, করোনা-পরবর্তী জটিলতার উপসর্গ হিসেবে তার খাদ্যনালির বিভিন্ন জায়গায় মাইক্রোহেমারিজ (ওবিটি) হয়েছে। এ জন্য স্টুলের সঙ্গে রক্ত গেলেও সেটি দেখা যায় না। ফলে তার শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে শরীরে আয়রন, প্রোটিন ও হিমোগ্লোবিনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যাওয়ায় খালেদা জিয়া আরো বেশি দুর্বল হয়ে পড়ছেন বলেও মনে করেন তারা। এ জন্য চার ব্যাগ রক্ত দেওয়ার পাশাপাশি তার মুখে খাওয়া এবং অ্যালুমিনিয়াম ইনজেকশনের মাধ্যমে তাকে প্রোটিনও দেয়া হয়েছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, খালেদা জিয়ার শরীর হিমোগ্লোবিন ও আয়রন তৈরি করতে পারছে না। তার অদৃশ্য রক্তক্ষরণ (ডিআই ব্লিডিং) হচ্ছে। এখন এটির কারণ বা উৎস খুঁজে পেতে হলে তার এন্ডোসকপি করতে হবে। আর এন্ডোসকপি করতে হলে খালেদা জিয়াকে অজ্ঞান করতে হবে। কিন্তু এটি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মতো একজন রোগীকে বাংলাদেশের একজন চিকিৎসকের পক্ষে করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। এ ধরনের পরীক্ষার জন্য অনেক সময় অন দ্য স্পট সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এ জন্য অত্যাধুনিক ও উন্নত কোনো কেন্দ্র নেই।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনে করেন, খালেদা জিয়ার বর্তমান শারীরিক অবস্থার কারণে তার বিশেষায়িত চিকিৎসা দরকার। তিনি বলেন, ম্যাডামের মতো জটিল রোগীদের উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা বিদেশেই রয়েছে। ফলে তাকে বিদেশে নেয়াই যুক্তিযুক্ত।
চিকিৎসকদলের সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন জানান, খালেদা জিয়া সুস্থ্য হয়ে কবে বাসায় ফিরবেন, সেটি মেডিক্যাল বোর্ডের পরামর্শের ওপর নির্ভর করছে। কারণ এখনো তিনি করোনা-পরবর্তী জটিলতায় ভুগছেন।
করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর ২৮ এপ্রিল থেকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়া। শ্বাসকষ্ট দেখা দেওয়ায় ৩ মে থেকে ৪ জুন পর্যন্ত সিসিইউয়ে থাকার পর এখন তাকে কেবিনে দেয়া হয়েছে। তবে পুরোপুরি সুস্থ্য হয়ে কবে তিনি বাসায় যেতে পারবেন, সে বিষয়ে চিকিৎসকরা এখনই কিছু বলতে পারছেন না। কারণ এখনো তিনি করোনা-পরবর্তী জটিলতায় ভুগছেন। তথ্যসূত্র : পূর্বপশ্চিমবিডি