এক ঐতিহাসিক আনন্দ ও গৌরবের মাহেন্দ্রক্ষণে আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দাঁড়িয়ে। বিশ্বের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভার্ডের বয়স যখন ৩৮৫ বছর, ক্যামব্রিজের বয়স ৭৫৫ বছর, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ৯১৫ বছর, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স কেবল একশত। মহাকালের গর্ভে একশত বছর খুব বেশি না হলেও একটি দেশ সৃষ্টিতে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটুও বেশি নয়। তাই বিশ্বের যেকোন প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বসেরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণায় লেখা ছিল– এই প্রতিষ্ঠান শুধু জ্ঞান বিতরণের জন্য স্থাপন করা হচ্ছে না, নেতৃত্ব গুণসম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ মানুষ গড়ে তোলাই এর মূল উদ্দেশ্য।
স্যার এ.এফ. রহমান, ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার, অধ্যাপক মাহমুদ হাসান, অধ্যাপক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসাইন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বিচারপরি হাবিবুর রহমান শেলি, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, বুদ্ধদেব বসু, জি.সি. দেব, মুনীর চৌধুরী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বিজ্ঞানী আব্দুল মতিন চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম, তালুকদার মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন প্রমুখেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখিয়েছে নতুন পথ, নতুন আলো। সে আলোর পথ ধরে এগিয়ে গেছে এ জনপদের মানুষ। পদার্পণ করেছে এক নতুন যুগে, নতুন দেশে। সে দেশ বাংলাদেশ। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধিকার আন্দোলন, ৬ দফা হয়ে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ — সকল ক্ষেত্রেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনন্য, অসাধারণ ও সম্মুখ সারিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে যারা দেশ এবং আন্তর্জাতিকভাবে নিজেদেরকে অনন্য উচ্চতায় স্থাপন করেছেন, তাদের মধ্যে ড. মুহম্মদ ইউনুস (নোবেল বিজয়ী), বিজ্ঞানী এম.এ. ওয়াজেদ মিয়া, এস.এ.এম.এস কিবরিয়া, বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ, সাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, জাহানারা ইমাম, ড. হুমায়ুন আজাদ, ড. হুমায়ুন আহমেদ, ড. জাফর ইকবাল অন্যতম। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তিনিও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী।
বাঙালি রাজনৈতিকভাবে প্রথম সচেতন হয়েছে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিটি এসেছিল স্বদেশি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৯০৬ সালে। তারপরের ইতিহাস করুণ, রক্তাক্ত ও বিশ্বাসঘাতকতায় পূর্ণ।
জাতীয়তাবাদের উপাদানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভাষা। ভাষাই জাতীয়তাবাদের প্রধান ভিত্তি।
বাংলাদেশের প্রথম শহিদ মিনার প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের ক্ষেত্রে বড় প্রেরণা যুগিয়েছে। এর পথ ধরেই রচিত হয়েছে ‘৬৯ – এর গণ অভ্যুত্থান এবং ‘৭১ – এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ। অবশেষে জন্ম নিল স্বাধীন ভাষিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ। পরবর্তীকালে ১৯৯৯ সালে এই গৌরবের পথ ধরে বাংলা ভাষা পেল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি। আমি ঢাকা বিশ্বদিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র। যে বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একই বিভাগের শিক্ষক ছিলেন বহু ভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। সে কারণে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্ররা বিশেষ গৌরব বোধ করেন। উল্লেখ্য যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুষ্টিমেয় যে কয়টি বিভাগ নিয়ে ১৯২১ সালের ১ লা জুলাই যাত্রা শুরু করে তার মধ্যে আইন বিভাগ অন্যতম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর দেয়ালে একটি লেখা দেখে মন আনচান করে উঠেছিল– ” জেগে উঠল কি সময়ের ঘড়ি, এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি ” — কিশোর কবি সুকান্তের এই চরণ কিশোর তথা প্রাক-যৌবনে আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে, বিপ্লবী হওয়ার চেষ্টাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই সেই সময়ের উত্তপ্ত জাতীয় রাজনৈতিক তাপ আমাকেও দগ্ধ করেছে।
ঢাকা বিশবিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে বলতে চাই, আমাদের মধ্যে অহংবোধ নয় একজন ভালো মানুষ জন্মগ্রহণ করুক, মমতা ও ভালোবাসার প্রকাশ ঘটুক পূর্ণ মাত্রায়। ভালোবাসার মধ্য দিয়ে আমাদের হৃদয় আরো প্রস্ফূটিত হোক যাতে আমরা আরো বেশি সেবা ও ভালোবাসা দিতে পারি। জীবনের উদ্দেশ্য তো তা-ই। দেশ ও মানুষের জন্য কিছু করতে পারলাম কী না – এটাই আসলে সবার কাজের মূল প্রেরণা হওয়া উচিৎ। এ চিন্তাটা সবসময় সামনে থাকলে একজন মানুষ অসাধারণ অর্জনের শক্তি পায়। আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি নিজের কাজ সবচেয়ে ভালোভাবে করাই প্রকৃত দেশপ্রেম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্ররা যেমন সফলতার গর্বে গর্বিত হন, তেমনি অনেককেই দেখা যায় ব্যর্থতার গল্প শোনাতে। আমি বিশ্বাস করি, সফলতার গল্পে কেবল একটি বার্তা থাকে, কিন্তু ব্যর্থতার গল্পে সফল হওয়ার অনেক উপায় নিহিত থাকে। প্রকৃত প্রস্তাবে শেষ্ঠ্যত্ব একটা অবিরাম প্রক্রিয়া। এটা কোন নিছক ঘটনা বা দুর্ঘটনা নয়।
জন্ম থেকে আমাদের অনেক ঋণ রয়েছে, যা শোধ করার চেষ্টা করা উচিৎ। মাথার উপর যে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে, আমরা কি জানি Tomas Alva Edison ১০,০০০ বার ব্যর্থ চেষ্টার পর তা আবিষ্কার করেন। কীভাবে আপনি এই ঋণ শোধ করবেন? একটাই উপায়, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ভালো কিছু করে যাওয়া, রেখে যাওয়া। চারিদিকে আলো ছড়ানোর নিরন্তর চেষ্টা করা। সে লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ও বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি চাই সংঘবদ্ধ উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা। কারণ ব্যক্তি প্রধানত শক্তিহীন — যদি না সে যুক্ত হতে পারে সমষ্টির সাথে। ফেসবুকের জগতে “সামাজিক যোগাযোগ” নয়, প্রয়োজন প্রত্যক্ষ মানবিক যোগাযোগ।
বাংলাদেশের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে আমার আপনার ব্যাপক দায়িত্ব রয়েছে, যা আমরা কোনক্রমেই অস্বীকার করতে পারি না। জীবনে চ্যালেঞ্জ নিতে পারেন কিনা, আপনি কঠিন সময়ে ভেঙ্গে পড়েন নাকি দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন — এটাই মানুষ হিসেবে আপনার নিয়ামক যোগ্যতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের ভাষায়-
” চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে, অন্তরে আজ দেখব যখন আলোক নাহিরে…” —
চোখের আলো হারালেও আমরা যেন মনের আলো না হারাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে এটাই আমার অন্তরের আকুতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে গর্ব ও আনন্দ দুটোই আমার রয়েছে। আসলে জীবন এক যাযাবর। জীবনের প্রয়োজনেই অনেকের সঙ্গে মিশতে হয়, পথ চলতে হয়। আজ প্রচলিত পড়াশোনা শেষ করে তথাকথিত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে, সংসার করছি। জীবনের একেক সময়ের অনুভূতি একেক রকম। প্রত্যেক সময়ের নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে। বেঁচে থাকাটাই আনন্দের। ভোরের শিশিরস্নাত সকাল, তরুলতা, গাছপালা ভরা নিঃস্বার্থ প্রকৃতিকে ভালোবেসেও জীবনটাকে উপভোগ করা যায়। যতই টানাপোড়ন থাকুক তবুও দিন শেষে জীবন মানে উৎসব। প্রতি মুহূর্তে ইংরেজ কবি Lord Tennyson – এর ভাষায় বলা যায়, ” I will drink life to the lees.” সদ্য কিশোর পেরুনো ছেলে-মেয়েরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, তখন তারা নিতান্তই সাধারণ কিন্তু তুমুল স্বপ্নবাজ। এখান থেকে উত্তীর্ণ হয়েই তারা স্ব-স্ব পেশায় সফলতার শীর্ষে। এই রূপান্তর দেখাটা সত্যি স্বর্গীয় আনন্দের। বারবার এই আনন্দের দেখা পেতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কাজ করে যাচ্ছেন। সৃষ্টিকর্তা যদি আবার বা বারবার আমাকে জন্মলাভের সুযোগ দেন, তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের মাটিতেই কাজ করতে চাই — অন্য কোথাও নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শত ভাবনা বিকশিত হোক। শত চিন্তার প্রসারে ঘটুক ব্যক্তি ও জাতির ক্রম-উত্তোরণ। স্বপ্নে-কর্মে-উদ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমাগত আরো প্রস্ফূটিত হোক, জন প্রত্যাশা পূরণ করুক, এটাই আন্তরিক প্রত্যাশা।
*শেখ মফিজুর রহমান- সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ, সাতক্ষীরা