জাতীয়

‘তোরে জজ বানাইছে কেডা’ যাঁরা বলেন, তাঁদের হাতে বিচার বিভাগ?

By Daily Satkhira

May 25, 2017

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানিতে আ্যমিকাস কিউরি হিসেবে নিযুক্ত ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ আপিল বিভাগের উদ্দেশে  বলেছেন, যাঁরা সংসদে দাঁড়িয়ে ‘তোরে জজ বানাইছে কেডা’ বলেন, তাঁদের হাতে বিচার বিভাগ ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না।

আজ বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহার নেতৃত্বে সাত সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের উদ্দেশে রোকনউদ্দিন এই মন্তব্য করেন।

সর্বোচ্চ আদালতের উদ্দেশে  রোকনউদ্দিন বলেন,  ‘তোরে জজ বানাইছে কেডা -পত্রিকায় এ রকম দেখেছি। যাঁরা সংসদে দাঁড়িয়ে এ রকম কথা বলেন, তাঁদের হাতে এটা (বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা) ছেড়ে দেবেন? তখন জুডিশিয়ারির স্বাধীনতা থাকবে?’

‘সবচেয়ে ক্লাসে (সর্বোচ্চ শ্রেণি) হচ্ছেন আপনারা (বিচারপতিরা)। শিক্ষা-দীক্ষায় আর সম্মানে আপনারা ক্লাসে। আপনাদের সম্মান থাকবে না? বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকবে না? তারা (সংসদ সদস্যরা) আপনাদের নিয়ে এ রকম মন্তব্য করেন’, যোগ করেন রোকনউদ্দিন।

বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দিয়ে করা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সপ্তম দিনের মতো আজ আপিল শুনানি হয়।

আজ শুনানিতে আগের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে রোকনউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের জজ নিয়ে সংসদে আলোচনার সুযোগ নেই। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এমপিরা আলোচনা করেছেন। কিন্তু স্পিকার টু শব্দ করেননি। বলছি না, আপনাদেরও (বিচারপতিরা) ত্রুটি নেই, দোষে-গুণে মানুষ। যে রায়ের (ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে হাইকোর্টের রায়) কথা বলছি, সেখানে দুটি শব্দ বাদ দিয়ে দেবেন, আশা করছি।’

‘সিভিল সার্ভিসের ব্যক্তিদের কারা অপসারণ করেন? পুলিশ সদস্যদের কারা করেন? সেক্রেটারিদের কারা করেন? আপনি? সংসদ? কেউ না। তাদের উপরস্থরা রিমুভ করেন। অর্থাৎ সহকারী সচিবদের তদন্ত করেন যুগ্ম সচিবরা। পুলিশের করেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। মিলিটারিদেরটায়ও তাদের ডিসিপ্লিনারি আছে। তাহলে আপনাদেরটা কেন পার্লামেন্টে যাবে? সচিব, পুলিশ তো সংসদে যাচ্ছে না, তাহলে এটি কেন?’

সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কথা আলোচনা করতে গিয়ে রোকনউদ্দিন মাহমুদ  বলেন, ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল না থাকলে এখানে অরাজকতা হবে। আর এটি (ষোড়শ সংশোধনী) যদি হয়ে যায়, তাহলে হাইকোর্টের জজদের তো আপনি (প্রধান বিচারপতি) কিছু বলতে পারবেন না। তাঁরা যদি বেলা ১১টায় আসেন, তখনো কিছুই বলতে পারবেন না। অথবা খাসকামরায় কোনো ব্যক্তির সঙ্গে যখন কথা বলবেন, তখন সংসদ কি দেখবে? এটা সংসদ জানবেও না। তাকে কে জানাবে?’

জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী বলেন, ‘সংসদে ষোড়শ সংশোধনী যদি পাস হয়, তাহলে আপনারা (বিচারপতি) শুধু বেঞ্চ গঠন করতে পারবেন। এ ছাড়া কিছু করতে পারবেন না। এর মাধ্যমে সরকারি লোকজন বিচারকের খাস কামরায় প্রবেশ করতে পারবে। কোনো বিষয়ে রায় হলে, তা নিয়ে সংসদে আলোচনা উঠবে। ’

ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিনের উল্লিখিত বক্তব্যের পর বিচারপতি টি এইচ খানের পক্ষে তাঁর ছেলে আফজাল এইচ খান বক্তব্য দেন।  উভয়ের বক্তব্য শেষে আদালত আগামী রোববার পর্যন্ত শুনানি মুলতবি ঘোষণা করেন।

এর আগে গত ৮, ৯ এবং ২১,২২,২৩ ও ২৪ মে এই মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি এ মামলায় আপিল শুনানিতে সহায়তার জন্য ১২ আইনজীবীকে আদালতের বন্ধু (অ্যামিকাস কিউরি) হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তাঁদের লিখিত বক্তব্য আদালতে জমা দিতে বলেন আপিল বিভাগ।

অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত ১২ আইনজীবী হচ্ছেন—বিচারপতি টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, এ এফ হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, এ জে মোহাম্মদ আলী, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম কামাল, ব্যারিস্টার আজমালুল হক কিউসি, আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া ও এম আই ফারুকী।

বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে আনতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস করা হয়। পরে ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়।

পরে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন।

এ আবেদনের ওপর প্রাথমিক শুনানি শেষে হাইকোর্ট ওই সংশোধনী কেন অবৈধ, বাতিল ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন।

এ রুলের ওপর শুনানি শেষে গত ৫ মে আদালত সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকের মতামতের ভিত্তিতে ১৬তম সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেন। তিন বিচারকের মধ্যে একজন রিট আবেদনটি খারিজ করেন।

এর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতামতের ভিত্তিতে রায় প্রকাশিত হয় গত বছরের ১১ আগস্ট এবং রিট খারিজ করে দেওয়া বিচারকের রায় প্রকাশিত হয় ৮ সেপ্টেম্বর। দুটি মিলে মোট ২৯০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে পরে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। ওই আপিলের ওপর শুনানি চলছে।

হাইকোর্টের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইনসভার কাছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা রয়েছে। দেশের সংবিধানেও শুরুতে এই বিধান ছিল। তবে সেটি ইতিহাসের দুর্ঘটনা মাত্র।

রায়ে আরো বলা হয়, কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর ৬৩ শতাংশের অ্যাডহক ট্রাইব্যুনাল বা ডিসিপ্লিনারি কাউন্সিলরের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের বিধান রয়েছে।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানটি তুলে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন এনে বিচারকের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়, যেটি ১৯৭২ সালের সংবিধানেও ছিল।