এম বেলাল হোসাইন/বি এম আলাউদ্দীন : আশাশুনি উপজেলার বড়দল ইউনিয়র্নের গোয়ালডাংগা গ্রামের অদম্য মেধাবী অপরাজেয় প্রতিবন্ধী খায়রুল ইসলামের বাড়িতে গিয়ে তার সাথে সাক্ষাত করেন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা, কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হক এমপি। অনলাইন নিউজ পোর্টাল ডেইলি সাতক্ষীরায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের সূত্র ধরে রোববার বেলা ১২টায় এমপি রুহুল হক খায়রুলকে দেখতে তার বাড়িতে যান। এসময় তিনি প্রতিবন্ধী খায়রুলের সার্বিক্র খোঁজ-খর্বর নেন এবং খায়রুল ও তার মায়ের হাতে রমজানের বিশেষ উপহার তুলে দেন। এসময় তার সাথে ছিলেন, প্রতাপনগর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ জাকির হোসেন, খাজরা ইউপি চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ ডালিম, বড়দল ইউপি চেয়ারম্যান আলীম মোল্যা, দরগাহপুর ইউপি চেয়ারম্যান মিয়ারাজ হোসেন, কাদাকাটি ইউপি চেয়ারম্যান দিপংক কুমার মন্ডল, আনুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আলমগীর আলম লিটন, আওয়ামীলীগের আব্দুল হান্নান মন্টু সরদার, দৈনিক প্রথম আলোর স্টাফ রিপোর্টার কল্যাণ ব্যানার্জী, ডেইলি সাতক্ষীরার সাতক্ষীরার সম্পাদক ও প্রকাশক হাফিজুর রহমান মাসুম, সাংবাদিক ইয়ারব হোসেন প্রমুখ। প্রতিবন্ধী খায়রুল ডা. আ ফ ম রুহুল হক এমপি সাহের মত একজন মহৎ ব্যক্তি তার বাড়িতে আসায় তিনি আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বলেন, “আমার একটি সরকারি চাকরি হলে আমার অনেক উপকার হবে। আমি সমাজের কার্রোর বোঝা হয়্রে বেঁচে থাকতে চাই না।” উত্তরে এমপি রুহুল হক অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে বিভিন্ন সরকারি নিয়োগে প্রতিবন্ধী কোটায় খায়রুলকে আবেদন করতে বলেন। তিনি যথাসাধ্য সহযোগিতা করার আশ্বাস প্রদান করেন। এছাড়া ডা. আ ফ ম রুহুল হক এমপি আরো বলেন, প্রতিবন্ধী খায়রুলের মত একজন অদম্য মেধাবীকে লালন পালন করায় আমি এলাকাবাসীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সাথে সাথে তিনি খায়রুলের মাকেও ধন্যবাদ জানান। তার গর্ভে খায়রুলের মত একজন অদম্য মেধাবী জন্ম নেওয়ার জন্য। যে কিনা প্রতিবন্ধী হয়েও কারো বোঝা হয়ে বেঁচে থাকতে চায় না। সে আর ৫ জনের মত পরিশ্রম করে বেঁচে থাকতে চায়। তিনি এসময় প্রতিবন্ধী খায়রুলকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন। পরে খায়রুলের হাতে রমজান মাসের জন্য বিশেষ ইফতার সামগ্রী তুলে দেন এমপি রুহুল হক। উল্লেখ্য, খায়রুল ইসলাম সংসারের ঘানি টানার জীবনযুদ্ধের মধ্যেও কান্তিহীন পড়ালেখার মাধ্যমে মাস্টার্স পাশ করে সুস্থ মানুষদের তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। সৎ উদ্দেশ্য ও অদম্য ইচ্ছা থাকলে অনেক অসাধ্যকেও জয় করা সম্ভব তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ খায়রুল। আশাশুনি উপজেলার গোয়ালডাঙ্গা গ্রামের মোহাম্মদ আলি সরদারের পুত্র খায়রুল ইসলাম। তার বর্তমান বয়স ২৭ বছর। তিনি জন্মগত ভাবে প্রতিবন্ধী। দু’টি পা সম্পূর্ণ অচল। দু’হাতেও স্বাভাবিক কিছু করার সক্ষকতা নেই তার। এখন মুখে ভাত তুলেও খেতে পারেননা। কোন রকমে কলম চালাতে পারেন; তাও অতি কষ্টে। ২৭ বছর আগে তার জন্ম হয় পিতার ভিটা টেকাকাশিপুর গ্রামে। শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নেওয়ায় তার মাতার উপর নেমে আসে অভিশাপ। পিতা মোহাম্মদ আলি তার মা আমিরুন নেছাকে তালাক দিয়ে বিদায় করে দেন। তিন মাসের শিশুকে নিয়ে মা গোয়ালডাঙ্গায় পিতার ভিটায় আশ্রয় নেন। আর্থিক অনটনের মধ্যে কষ্টকর জীবন-যাপনের পথ ধরে তার বেড়ে ওঠা। সংসার নির্বাহের জন্য পরের বাড়িতে কাজ করতেন। প্রতিবন্ধী ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে ভবিষ্যৎ জীবনকে অন্ধকারমুক্ত করা যায় কিনা সে মনোস্কামনা নিয়ে ছেলেকে মাদরাসায় পাঠানো শুরু করেন। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ালেখাকালীণ খরচ যোগানোর তাগিদে টিউশনি শুরু করে খায়রুল। এভাবে নিজের খরচ নিজে যোগানোর মাধ্যমে গোয়ালডাঙ্গা শুক্কলিয়া দাখিল মাদরাসায় পড়ালেখা করে ২০০৫ সালে দাখিল পরীক্ষায় অংশ নেয় খায়রুল। সাধারণ পরীক্ষার্থীদেরকে তাক লাগিয়ে দিয়ে খায়রুল জিপিএ ৩.৬৭ পেয়ে কৃতিত্ব অর্জন করেন। এরপর বড়দল আলিম মাদারাসায় ভর্তির পর খরচ্র বেড়ে যাওয়ায় টিউশনিতে আরও বেশী সময় দিতে হতো। কিন্তু না সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিল। চলাফেরায় দুর্বলতা বেড়ে গেল। তখন বিয়ারিং এর গাড়িতে চড়ে চলাচল শুরু করলেন। জীবনযুদ্ধের মাঝে আবার লেখাপড়ায় সফলতা অর্জন করলেন তিনি; ২০০৭ সালে ২.১৭ পেয়ে আলিম পাশ করলেন। এরপর বড়দল আফতাব উদ্দিন কলেজিয়েট স্কুল হতে এইচএসসি এবং ২০০৯ সালে ফাজিল পাশ করেন ২.১৭ পেয়ে। চরম অভাব ও চলাচলে প্রতিবন্ধকতা এবং স্বাভাবিক জীবন যাপনে প্রতিকূলতা থাকা স্বত্তেও লেখাপড়া থামেনি। ২০১৩ সালে আশাশুনি কলেজ হতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামের ইতিহাসে প্রথম শ্রেণিতে অনার্স পাশ করেন। অদম্য আগ্রহ সহকারে তিনি খুলনা বিএল কলেজ থেকে মাস্টার্স (ইসলামের ইতিহাস) পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ২০১৬ সালে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। এর মধ্যে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এছাড়া সাতক্ষীরা আলিয়া মাদরাসা হতে ২০১৭ সালে হাদিস গ্রুপ থেকে কামিল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। আবার যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে মৎস্য চাষ ও খাদ্য উৎপাদন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। লেখাপড়ায় ঈর্ষণীয় সফলতা পেয়ে জীবনে বড় কিছু হওয়ার আগ্রহ বেড়ে গেলেও তার জীবনের বড় বিপত্তি শুরু হয় ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ। এদিন রাতে মাথার পাশে জ্বলন্ত গ্লোব রেখে মশারি টানিয়ে ঘুমিয়ে যান। কোন এক সময় মশারিতে আগুন লেগে পুরো ঘরে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তার সমস্ত শরীর আগুনে ঝলছে যায়। তাকে নেওয়া হয় প্রথমে আশাশুনি হাসপাতালে এবং পরে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে। এখানে তাকে ৮ মাস ধরে চিকিৎসা নিতে হয়। চিকিৎসা শেষে পোড়া ঘা শুকিয়ে গেলেও তার পঙ্গুত্ব কয়েকগুণ বেড়ে যায়। হাত-পা চালানোর শক্তি বহুগুণ হারিয়ে যায়। এখন অন্যের সহযোগিতা ছাড়া নিজেকে পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে গেছ। মোজাহার উদ্দীন মাল্টিক্রাফট সেন্টারে শিশু শিক্ষার ছোট্ট একটি চাকুরি পেলেও সেটি টিকিয়ে রাখতে পারেননি। বর্তমানে টিউশনির ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাও ধরে রাখতে পারছেন না। বর্তমানে একটি পুরনো হুইল চেয়ারে চড়ে তার চলাচল। যেটি ২০০৭ সালে ঋশিল্পী দিয়েছিল। তেতুলিয়া আশ্রয়ন আবাসনে বসবাসকারী অসহায় খায়রুল এখন ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে খুবই চিন্তিত। তারপরও তার অসীম আগ্রত তাকে থামিয়ে রাখতে পারছেনা। তার ইচ্ছা বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেয়া। তিনি বলেন সমাজের বোঝা হয়ে থাকার মধ্যে কোন তৃপ্তি নেই। কিন্তু প্রতিবন্ধিতা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। তবুও তিনি হতাশ হতে রাজি নন। তার প্রত্যাশা বিসিএস দিয়ে একটি অবলম্বন তার ভাগ্যে জুটাতে চান তিনি। জীবনকে যতটুকু সম্ভব স্বাভাবিক করতে সচেতন মানুষের সহানুভূতিপূর্ণ ব্যবহার প্রত্যাশা করা তার জন্য বেশি কিছু চাওয়া নয় বলে মনে করেন তিনি।