খোলা মত

মায়াবতীদের গল্প- ইয়াসমিন নাহার

By daily satkhira

September 07, 2021

আচ্ছা, শুধু সন্তান জন্মদান করেই কি মা হয়ে গেলাম? এই প্রশ্নটা মাঝে মাঝেই মাথায় ঘোরে আমার। নিজের কথা বলি – সন্তান জন্ম দেয়ার পরে আমার মনে হয়েছিলো, কিছু সময় হাত – পা ছেড়ে ঘুমাই! জানি শুনতে কেমন যেন লাগছে! এ কেমন মা? বাচ্চার কথা চিন্তা না করে নিজের ঘুমানোর চিন্তা করে! বাচ্চাটা গর্ভে আসার পর থেকেই চরম এসিডিটি, মুখে মনে হতো তিনটা করলার রস মাখানো। ভাত খেতে পারি না, মনে হতো বোধ হয় রুটি খেতে পারবো কিন্তু সেটাও মুখে দিলে গা গুলিয়ে আসে। কষ্ট করে যা একটু খাই, খাওয়ার পরেই হড় হড় করে সব তুলে দিতাম। কিন্তু শেষের দিকে আরেক কষ্ট শোয়া যায় না, বসা যায় না। লাথি খাই, গুঁতা খাই। ঘুমের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসে, চিন্তায় কলিজা ছোট হয়ে যায় – বাঁচবো তো?

আজ বলবো মায়েদের কথা, মায়াবতীদের কথা। আমরা, আমাদের সমাজের লোকেরা সব সময়ই যেটা ভাবি তা হলো – সন্তান জন্ম দিয়েছো তুমি, সব দায়িত্ব তোমার। মা হয়েছো, এটুকু কষ্ট করতে পারবে না? আরে মা হওয়া কি এতো সহজ নাকি? ইত্যাদি ইত্যাদি। ‘মা’ হওয়া যে সহজ নয়, তা একজন ‘মা’ই জানেন।কারণ – এক. সন্তান জন্ম হওয়ার আগের কষ্ট – খেতে না পারা, বমি, ঘুমাতে না পারা, শতটা বিধি নিষেধ, আর কারো শারীরিক সমস্যা থাকলে তো বিছানা থেকে উঠতেই পারে না। দুই. সন্তান জন্ম দেয়ার সময় কষ্ট তা স্বাভাবিকভাবে হোক বা সি সেকশনের মাধ্যমে হোক। শুধু একজন মা’ই জানেন কি মারাত্মক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এর সাথে যুক্ত হয় প্রসব পরবর্তী নানা জটিলতা। তিন. বাচ্চা জন্মানোর পরের কষ্ট।

যেকোন শারীরিক অসুস্থতা বা যেকোন ধরণের ছোট বড় অপারেশনে সবাই বিশ্রামের সুযোগ পায় আর পায় পরিচর্যা কিন্তু একমাত্র মা হওয়ার পরে কোন বিশ্রামের সুযোগ নেই উলটো পৃথিবীতে আসা ছোট্ট মানব শিশুকে নিবিড়ভাবে পরিচর্যা করতে হয় তাঁকে। তাতেও কোন সমস্যা ছিলো না যদি না আমাদের মনোভাবের পরিবর্তন হতো। সব সময়, সব পরিবেশে মা’ই সন্তানের পেছনে সব সময় লেগে থাকবে – এটাই ভাবা হয়। বাচ্চা কাঁদছে কেন – মা শুনতে পায় না? বাচ্চা ঘুমাচ্ছে না কেন? মা কিভাবে ঘুম পাড়াতে হয়, জানে না। বাচ্চা অসুস্থ হলো কেন – মা যত্ন নিতে জানে না..!! কিন্তু আমরা কি জানি মা ও একজন মানুষ। তার ঘুম পায়, তার একটু হলেও নিজের জন্য সময় দরকার? প্রতিবেলা খাবার গেলার পরিবর্তে তারও একটু মনে হয় আস্তে ধীরে খায়! আমরা কতজন জানি বাচ্চা হওয়ার পরে অনেক মা বিষন্নতায় ভোগেন যাকে মেডিকেল টার্মে Baby Blues এবং Postpartum Depression বলে। (অনলাইনে সার্চ দিলে এই বিষয়ে অনেক মেডিকেল জার্নালে তথ্যবহুল লেখা পাবেন)। এই বিষন্নতার কারণ শুধু ঘুমের অভাব নয়। এই বিষন্নতার কারণ আমাদের সহযোগীতা আর মনোযোগের অভাব, আমাদের যত্নের অভাব। তুমি মা, তুমি কেন পারো না – আমাদের এই কথার কারণে কত মা নিজেকে খারাপ মা ভাবেন তা কি আমরা জানি? মা’ কে দেবীর আসনে বসিয়ে তাঁকে সব দুঃখ কষ্টের উর্ধ্বে ভাববেন না, তিনি মানুষ তাঁর মানসিক সহযোগীতার পাশাপাশি দরকার তাঁকে নিজের যত্ন নেয়ার জন্য সাহায্য করা। দয়া করে বলবেন না আমার নানী – দাদী, মা বা আমি এই করেছি সেই করেছি তুমি কেন পারো না! কারণ অনেক মহামতী নারী দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, নোবেল জিতেছেন আপনি বা আপনার নানী দাদী কি তা পেরেছেন? জ্বী সবাই সব পারবে না সেটাই সত্য। তাহলে একা মা কেন সব পারবেন? তাঁকেই কেন সব পারতে হবে?

ফিরে যাবো প্রথম কথায়, একদিনে মা আমি হই নি। প্রতিদিন একটু একটু করে হয়েছি। প্রথম যেদিন টেস্টের রেজাল্ট পেয়েছি সেদিন থেকে প্রতিনিয়ত একটু একটু করে ‘মা’ হয়েছি, ঠিক তেমনি বাচ্চাটা যখন ‘মা’ বলে ডাকলো সেদিন তেমন বুঝেছি ‘মা’ হয়েছি, আজ যখন গলা জড়ায়ে ধরে মুখে চুম্বন করে তখন বুঝি ‘মা’ হয়েছি। সন্তানের বিপদে অসুখে অস্থির মন আর নির্ঘুম রাত বলে দেয় ‘মা’ হয়েছি। আমি, আমরা তো ‘মা’ হয়েছি এখন আপনারা আমাদের পাশে থেকে, সহযোগীতার, সহমর্মিতার হাত বাড়ায়ে ‘বাবা’, ‘দাদা-দাদি’, ‘নানা- নানি’, ‘চাচা’, ‘ফুফু’, ‘খালা’, ‘মামা’ হোন।

লেখক : সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট