জাতীয়

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে ৫৪৪ দিন পর

By Daily Satkhira

September 12, 2021

শিক্ষা ডেস্ক : আবার শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হচ্ছে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্বাস্থ্যবিধি মেনে আজ ১২ সেপ্টেম্বর খুলছে দেশের স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা। ৫৪৪ দিন পর শিক্ষার্থীরা ফিরছে ক্লাসে। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় সোয়া তিন কোটি ছাত্রছাত্রী আছে। সরাসরি পাঠদানের লক্ষ্যে বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে বন্যা কবলিত এলাকা এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক প্রতিষ্ঠান এখনও পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি।

প্রতিষ্ঠান খোলার ক্ষেত্রে করোনাসংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশিকা অনুসরণ করা হচ্ছে। পাঠদান চলাকালে স্বাস্থ্য সুরক্ষাসংক্রান্ত নিয়মাবলি কঠোরভাবে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। পাশাপাশি দুই স্তরে তা মনিটরিং করা হবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই দৈনিক আসবে আলাদা দুটি মনিটরিং প্রতিবেদন। এছাড়া শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে অন্তত ৮০ শতাংশকে অন্তত এক ডোজ টিকা নিশ্চিতের উদ্যোগ নেওয়া হয়। শিক্ষা কার্যক্রম পুনরায় শুরুর সার্বিক কাজ তদারকির জন্য ছুটির দিনেও আজ শিক্ষা মন্ত্রণালয় খোলা রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে প্রায় ৬৬ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। এগুলো অভিন্ন ক্লাস রুটিনে চলবে। প্রায় অর্ধলক্ষ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এগুলো অবশ্য নিজ নিজ রুটিন অনুসরণ করবে। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য আলাদাভাবে দফায় দফায় নির্দেশিকা পাঠিয়েছে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাতে শিক্ষার্থী, প্রতিষ্ঠান প্রধান, সাধারণ শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটিসহ সংশ্লিষ্ট ৯ স্তরের জন্য আলাদা করণীয় উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্ত অনুাযায়ী, ১০টি মূলনীতি অনুসরণ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করতে বলা হয়েছে। আর দৈনন্দিন লেখাপড়া ও মূল্যায়নে অনুসরণ করা হবে ৮টি নীতি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন শুক্রবার বলেন, সরকারের কাছে মূল অগ্রাধিকার ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা। সেটিকে সামনে রেখে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় পুনরায় লেখাপড়া শুরুর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। করোনাসংক্রমণ থেকে সুরক্ষায় নির্দেশিত পন্থায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন, বসানোর ক্ষেত্রে শারীরিক দূরত্ব ইত্যাদি কঠোরভাবে অনুসরণ করা হবে। এ সংক্রান্ত বিভিন্ন নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। ৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রস্তুত করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি নির্দেশনা অনুসৃত হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিতে শিক্ষার মাঠপ্রশাসন কাজ করছে। কেন্দ্রীয়ভাবেও সবকিছু তদারকি করা হচ্ছে। আমরা আশা করছি, সবাই প্রস্তুত। এরপরও কাল (আজ) সবশেষ পরিদর্শন করবেন মাঠপর্যায়ের শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

৩ সেপ্টেম্বর শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেন। ওই ঘোষণায় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এক প্রকার হিল্লোল বয়ে গেছে। প্রায় সব শিক্ষার্থী অপেক্ষা করছে কখন স্কুলে যাবে। পাশাপাশি গত কয়েকদিন ধরে দেখা গেছে তাদের প্রস্তুতি। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বাজার ও বিপণিবিতানগুলোতে শিক্ষাসামগ্রী বিশেষ করে জুতা-মোজা, ব্যাগ এবং স্কুল ড্রেস কিনতে দেখা গেছে। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানাতে শিক্ষকরাও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। শিক্ষকরা এ কদিন ব্যস্ত ছিলেন পুনরায় শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর প্রস্তুতি নিয়ে। একদিকে তারা পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালান। আরেকদিকে সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক রুটিন তৈরির পাশাপাশি ক্লাসরুমে শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করে বসানো, হাত ধোয়া, অসুস্থ হলে বিশেষ কক্ষে পরিচর্যা ইত্যাদি প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক কামরুন নাহার বলেন, সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক ওয়াশ ব্লক প্রস্তুত, ক্যাম্পাস পরিচ্ছন্ন, বসানোর ব্যবস্থাসহ সার্বিক প্রস্তুতি নেওয়া সম্পন্ন হয়েছে। আমরা ছাত্রছাত্রীদের রোববার আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে বরণ করে নেব। আর উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ জহুরা বেগম বলেন, শ্রেণি কার্যক্রম শুরুর লক্ষ্যে আমরা ইতোমধ্যে রুটিন তৈরি করেছি। শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়া হবে। আমাদের বেশিরভাগ শিক্ষক ও কর্মচারী টিকা নিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের পরিচ্ছন্নতার সুবিধার্থে প্রতিটি ভবনে ওয়াশ ব্লকে আমরা লিকুইড সাবান রাখার ব্যবস্থা করেছি। এছাড়া প্রতিটি ভবনের প্রবেশদ্বারে বেসিন ও সাবান থাকবে। স্কুলের তিনটি গেটকে আলাদাভাবে প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য ব্যবহার করা হবে। অভিভাবকরা গেটের অদূরে অবস্থান করবেন। তাদের জন্য সীমানা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। ছোট ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের সেখান থেকে শিক্ষকরা গ্রহণ করবেন। এছাড়া স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ে অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে ব্যানার ও ফেস্টুন তৈরি করা হয়েছে।

দশ বিষয় বাধ্যতামূলক : চেকলিস্টের মাধ্যমে দৈনিক তদারকি করা হবে প্রতিষ্ঠান, এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠাতে হবে ঢাকায়; শিক্ষার্থীদের দৈনিক সচেতন করা হবে; বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক ব্যবহার; হাত ধোয়ার ব্যবস্থা; দৈনিক প্রত্যেকের শরীরের তাপমাত্রা যাচাই- এজন্য গেটে ৩০ মিনিট সময় বরাদ্দ; প্রয়োজনে পিসিআর ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা; লক্ষণ থাকলে শিক্ষার্থীকে অনুপস্থিত হিসাবে বিবেচনা না করা; স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে ক্লাসরুমে বসানো; স্কুলে সমাবেশ না করা, তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাসরুমে যার যার সিটে রেখে হালকা শারীরিক কসরত; পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা; হোস্টেলে বিশেষ নির্দেশনা অনুসরণ।

পাঠ ও মূল্যায়ন নীতি : পরিকল্পনা অনুযায়ী, স্কুল খোলার পর এসএসসি ও এইচএসসি এবং পিইসি পরীক্ষার্থীদের ক্লাস সপ্তাহে ৬ দিন হবে। প্রথম থেকে চতুর্থ এবং ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির ক্লাস হবে সপ্তাহে একদিন। এবারের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু হলে নবম শ্রেণির পাঠদানের দিন সংখ্যা বাড়বে। আর পরিস্থিতি বিবেচনায় অন্য শ্রেণির পাঠদানের দিন সংখ্যাও বাড়বে। পাশাপাশি পরিস্থিতি বিবেচনায় জেএসসি ও সমমানের পরীক্ষার সিদ্ধান্ত হবে। একই নীতি হবে পিইসি পরীক্ষার ব্যাপারে। প্রাক-প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের সশরীরে ক্লাস আপাতত বন্ধ থাকবে। কোনো শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকলে সেই তালিকা তৈরির পাশাপাশি এর কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। শিখন ফল ঘাটতি চিহ্নিত ও তা পূরণে ব্যবস্থা গ্রহণ।

দৈনিক মনিটরিং : দুই স্তরে হবে মনিটরিং। প্রথম স্তরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানই সবদিকে নজর রাখবেন। যে কোনো সমস্যাসহ সার্বিক দিক তিনি দৈনিকই বেলা ৩টার মধ্যে মাউশিকে জানাবেন। একইভাবে উপজেলা ও থানা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তারাও মনিটরিং করে প্রতিবেদন প্রতিদিন বিকাল ৪টার মধ্যে মাউশিতে জানাবেন।

প্রাথমিকে মৌলিক রুটিন : প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর স্কুলগুলোতে অনুসরণের জন্য মৌলিক রুটিন তৈরি করেছে। এটি ইতোমধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। এতে দেখা গেছে, প্রতিদিন পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস হবে। সঙ্গে একেক দিন এক একটি শ্রেণির ক্লাস হবে। যেসব স্কুলে শিক্ষার্থী বেশি সেখানে প্রয়োজনে দুই শিফটে ক্লাস নেওয়া যাবে। প্রথম শিফট সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে শুরু হয়ে ৩টা ঘণ্টা চলবে। দুপুরে ৩০ মিনিটের বিরতি থাকবে। এরপর ক্লাস শুরু হয়ে বেলা ৩টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত চলবে। প্রতিদিনই ক্লাস শুরুর আগে ১০ মিনিট করে কোভিড-১৯ স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতনতামূলক আলোচনা করতে হবে। এর আগে ৩০ মিনিট থাকবে শিক্ষার্থীদের স্কুলে প্রবেশের জন্য। একসঙ্গে প্রবেশ ও বের হওয়া যাবে না। বুধ ও বৃহস্পতিবার শুধু পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাবে। অন্য ৪ দিন তাদের সঙ্গে আরেকটি শ্রেণির ক্লাস হবে। সে ক্ষেত্রে শনিবার চতুর্থ, রোববার তৃতীয়, সোমবার দ্বিতীয় এবং মঙ্গলবার প্রথম শ্রেণির ক্লাস হবে। এ চার শ্রেণির শুধু বাংলা, গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে পাঠদান হবে। আর পঞ্চম শ্রেণির সব বিষয়েই পাঠদান চলবে।

‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর’ (এসওপি) : শিক্ষার উভয় মন্ত্রণালয়ই অনুসরণের জন্য নির্দেশিকা পাঠিয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এর মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের নির্দেশিকায় সংশ্লিষ্টদের ৯ ভাগ করা হয়েছে। এরা হলেন- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান, শিক্ষার্থী, সাধারণ শিক্ষক, অভিভাবক, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি এবং উপজেলা, জেলা ও আঞ্চলিক প্রশাসন।

আর প্রাথমিক স্তরের নির্দেশিকায় বিদ্যালয় প্রস্তুতকরণ, স্বাস্থ্য তথ্য সংগ্রহ ও মনিটরিং, স্কুলে আগমন ও বহির্গমন এবং আসন ব্যবস্থা ও শ্রেণি কার্যক্রমসংক্রান্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে শারীরিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধিসংক্রান্ত নির্দেশনার পাশাপাশি বলা হয়, করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রয়োজনে কোনো উপজেলায় বিপৎসীমা অতিক্রম করলে উপজেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটি সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার পাঠদান সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে বিষয়টি কমিটি জেলা প্রশাসন ও ডিপিইকে অবহিত করবে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্টরা টিকা নেবেন। তাদের পরিবারের সদস্যদেরও উৎসাহিত করতে হবে।

এদিকে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে শেষ মুহূর্তের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছে। শহরাঞ্চলের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই ইতোমধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। তবে প্রত্যন্ত এলাকার অনেক স্কুল-কলেজে শুক্রবারও ধোয়ামোছার কাজ করতে দেখা গেছে। কোনো কোনো স্কুলের সামনে এখনও আগাছা ও জলাবদ্ধতা দেখা যায়।

বরিশাল বিভাগে তিন শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে পাঠদানের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন শিক্ষক ও অভিভাবকরা। খুলনায় ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় আটটি বিদ্যালয়ের ক্লাস হবে পার্শ্ববর্তী প্রতিষ্ঠানে। চট্টগ্রাম বিভাগে সাড়ে ১১ হাজার বিদ্যালয় পাঠদানের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এছাড়া যশোরে প্রায় আড়াই হাজার প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত।