নিজস্ব প্রতিনিধি : সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার পাউখালি মহাশ্মশানের উপর দিয়ে পিচ ঢালাইয়ের রাস্তা নির্মাণ করাকে কেন্দ্র করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। জনপ্রতিনিধি ও ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা এটাকে সমর্থন করলেও কৌশলে নীরবতা পালন করে দায় এড়াতে চাইছেন। সরেজমিনে মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার পাউখালি মহাম্মশানে যেয়ে দেখা গেছে সেখানে দাহ করা হচ্ছিল বাজারগ্রামের গোপীরঞ্জন অধিকারীর মা গৌরী রাণী অধিকারীর লাশ। নির্মাণাধীন পাউখালি ব্রীজ থেকে মৌতলা নির্মাণাধীন রাস্তার উপর শ্মশান বেদিটি অবস্থান করছিল। আগুন জ্বলছিল দাউদাউ করে। পাশেই রয়েছে শ্মশান কালীমন্দির। শ্মশান থেকে ঢিঁল ছোঁড়া দূরত্বে নির্মিত হয়েছে পাউখালি কারিগরি স্কুল এণ্ড কলেজ। কলেজের নিকটেই আদি যমুনার চরে বসবাস করছেন কয়েকটি ভূমিহীন পরিবার।
প্রশ্ন রাখতেই গোপী রঞ্জন অধিকারী বলেন, রাস্তা নির্মাণের জন্য যখন নকশা তৈরি হলো তখন উপজেলা প্রকৌশলী থেকে শুরু করে উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ইউপি চেয়ারম্যান সকলেই জানতেন যে শত বছরের পুরাতন শ্মশানের উপর দিয়ে রাস্তা চলে যাবে। বিপন্ন হবে শ্মশানের কার্যক্রম। এরপরও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন প্রতিবাদ করেও কোন সদুত্তর পাননি। হিন্দু মহাজোট কালীগঞ্জ শাখার সাধারণ সম্পাদক গোপাল মণ্ডল বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শ্মশানের উপর দিয়ে পিচের রাস্তা বানানো হচ্ছে। তাহলে অন্য দলের সময়কালে মন্দিরের উপর দিয়েও রাস্তা হলে প্রতিবাদ করার কিছু থাকবে না।
মহৎপুর শাখারীপাড়ার বরুন কুমার দত্ত জানান, পাউখালি শ্মশানে পাউখালি, ভদ্রখালি, কুলিয়া , দিয়া, বাজারগ্রাম, কালীগঞ্জসহ কয়েকটি গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের মৃতদেহ সৎকার করা হয় এক’শ বছর আগে থেকে। পাউখালি ব্রীজ থেকে মৌতলা পর্যন্ত আদি যমুনা নদীর পাশ দিয়েই প্রায় দু’ কিলোমিটার রাস্তার নির্মাণ খরচ ধরা হয়েছে দু’ কোটি ৭০ লাখ টাকা। জনৈক ঠিকাদার রফিকুল ইসলাম এর নির্মাণ কাজের দায়িত্ব পেলেও রাস্তা নির্মাণ করছেন মতিয়ার রহমান ওরফে ভাটা মতি। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে রাস্তা নির্মাণের কাজ শুরু হলেও ঠিকাদার শ্মশান সমস্যার সমাধান না করেই কাজ অব্যহত রেখেছেন।
তিনি আরো জানান, পাউখালি শ্মশানের জন্য কুশুলিয়া ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান বাবলুর সহায়তার চার শতক জমি জেলা প্রশাসকের অনুকুলে শ্মশানের নামে বর্তমান সেটেলমেন্টে রেকর্ড হয়। শ্মশানের উপর দিয়ে রাস্তা চলে যাওয়ায় উপজেলা চেয়ারম্যান সাঈদ মেহেদী ও লতিফুর রহমান বাবলু পাউখালি কারিগরি স্কুল এণ্ড কলেজ গড়ে ওঠার কারণে শ্মশানটি কিছু দূরে ভূমিহীনদের বসতির পাশে পূণঃনির্মানের পরামর্শ দিলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই ভূমিহীনদের প্রতিবাদ শুরু হয়। ফলে রাস্তার মধ্যে বেদীর উপর চিতা সাজিয়ে শবদাহ করতে হচ্ছে।
তবে মহৎপুর আচার্যপাড়ার অমল কুমার আচার্য বলেন, শ্মশানের উপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণের ঘটনায় উপজেলা চেয়ারম্যান সাঈদ মেহেদী কোন মন্তব্য করেননি। তাই তারা ভেবে ছিলেন নদীর চরের দিকে শ্মশান বেদি নির্মাণ করতে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা খরচ হলে ঠিকাদার তা বহন করবেন। কিন্তু মতিয়ার রহমানের এ নিয়ে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তাই মঙ্গলবার গৌরী রানী অধিকারীর লাশসহ সম্প্রতি ভদ্রখালির করোনা আক্রান্ত এক ব্যক্তি, মহৎপুরের তারক আচার্যসহ কয়েকজনকে রাস্তার উপর শ্মশান বেদিতেই সৎকার করা হয়েছে। রাস্তার উপর বালি খোয়া থাকায় তারা সমস্যায় ছিলেন। শ্রীকলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক শিশির কুমার দত্ত বলেন, এটা দুর্ভাগ্যজনক। আগামিতে হয়তো লাশ সৎকার বাড়িতেই করতে হবে। সেখানে প্রতিবেশিরা আপত্তি করলে মুসিলমদের মত কবর দিতে হবে। কালিগঞ্জ সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সাহিত্যিক গাজী আজিজুর রহমান এক ফেসবুক কমেন্টে লিখেছেন ‘‘শ্মশানে কবরে কোথাও শান্তি নাই এ কেমন বর্বর সভ্যতা’’। একই কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক শ্যামপদ দাস লিখেছেন ‘‘এ কেমন রাস্তা, শ্মশানের উপর দিয়ে গেল? প্রশাসনের আশু ব্যবস্থার দাবি করছি। এ কাজ নিন্দনীয়। জয়মহাপ্রভু সেবক সংঘের সভাপতি গোষ্ট বিহারী মণ্ডল বলেন, গত কয়েক মাস আগে উপজেলার পিরোজপুর এলাকায় শ্মশানের জায়গা দখল করে নেওয়ার চেষ্টা করে উপজেলার শীর্ষ পর্যায়ের এক জনপ্রতিনিধি। সেটি স্থানীয়ভাবে প্রতিবাদ করে প্রতিহত করা হয়। কিন্তু এর কয়েক মাস যেতে না যেতেই ওই নেতার ইচ্ছায় পাউখালিতে অবস্থিত শতবছরের সার্বজনীন শ্মশানের উপর দিয়ে পিচের রাস্তা তৈরির কাজ চলছে। এ নিয়ে খুব শ্রীঘ্র বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে। ঠিকাদার রফিকুল ইসলাম বলেন, সিডিউল অনুযায়ী রাস্তার কাজ চলছে। রাস্তাটি তার নামে টেন্ডার হলেও কাজ করছে মতি। তার উচিত ছিলো রাস্তার কাজ শুরু করার আগে এ সমস্যার সমাধান করা। তাহলে এ বিতর্কে পড়তে হতো না। কালীগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী জাকির হোসেন বলেন, শ্মশানের উপর দিয়ে রাস্তা যাচ্ছে এটা তার জানা নেই। শ্মশানের উপর দিয়ে রাস্তা করে তারা ধর্মীয় অনুভূমিতে আঘাত করতে চান না। কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার রবিউল ইসলাম বলেন, বিষয়টি তার জানা নেই। এ ধরণের সমস্যার দ্রুত সমাধান করা হবে।