তালা ডেস্ক : মধু কবি, বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক পালাবদলের যুগ সন্ধিক্ষণের কবি। সেই কবি তার কপোতাক্ষ নদ কবিতায় জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসা প্রকাশে শৈশব আর কৈশরের স্মৃতি বিজড়িত নদের ¯্রােত ধারাকে জন্মভূমির বুকে মাতৃ দুগ্ধের আধার রূপে বর্ণনা করেছেন। সুদূর ইউরোপে বসে সতত তার এই ¯্রােতস্বিনী নদের কথা মনে পড়েছে। গভীর আবেগ আর মততায় তিনি কপোতাক্ষ নদকে সাহিত্যের এক অপার সৃষ্টি রূপে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। বৈদিক সাহিত্যের স্বরস্বতী নদী আজ আর বাস্তবে নদী নেই। একইভাবে মধু কবির কপোতাক্ষ নদও সাহিত্যে অমরত্ব পেলেও হারিয়ে যাচ্ছে মানচিত্র থেকে। চীনের হোয়াংহো নদীর মত সাতক্ষীরা, যশোর ও খুলনার দুঃখে পরিণত হয়েছে গঙ্গা ও পদ্মার শাখা ও মহকবি মাইকেল এর স্মৃতি বিজিড়িত কপোতাক্ষ নদ। জমি দখলের মত নদ দখল হয়ে যাওয়ায় প্রতি বছর এই তিন জেলার পাঁচটি উপজেলার অর্ধ শতাধিক গ্রাম বছরের ৮ থেকে ৯ মাস পানিতে তলিয়ে থাকছে। জলাবদ্ধতার কারণে ওই গ্রামগুলোর কয়েক হাজার হেক্টর ফসলি জমি এখন অনাবাদি জমিতে পরিনত হয়েছে। ঘরবাড়ি হারিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। স্কুল, কলেজগুলো পরিনত হয়েছে স্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে। এলাকাবাসী জলাবদ্ধ জমিতে বাঁধ দিয়ে সেচের মাধ্যমে পানি অপসারণ করে চাষাবাদ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সাতক্ষীরা জেলার তালা ও কলারোয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সরোজমিনে জনগণের সাথে আলাপ করে জানা যায়, যশোর, সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ইতিহাস খ্যাত কপোতাক্ষ নদ। যাত্রী ও মালামালা নিয়ে লঞ্চ এবং কার্গো চলাচল করতো যে নদে সেখানে এখন ছোট নৌকাও চলে না। এক সময় খরস্রোতা হলেও এখন মৃত প্রায় হয়ে গেছে সে সময়ের দুই শত থেকে আড়াই শত ফুটের বেশি চওড়া কপোতাক্ষ নদ। নব্বই এর দশকেও কপোতাক্ষ নদ তার স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বজায় রাখতে সক্ষম ছিল। কিন্তু এরপর নানা কারণে ভরাট হতে থাকে কপোতাক্ষের তলদেশ, এখন অনেক স্থানে ৫০ ফুটে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে বেশি বিপত্তি দেখা দেয় ২০০০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে। ২০০৯ সালের জুন মাসে বন্যার পানিতে কপোতাক্ষের দুই পাশের অর্থাৎ যশোরের কেশবপুর ও মনিরামপুর উপজেলা এবং সাতক্ষীরা জেলার তালা ও কলারোয়া উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। এই পানি নেমে যেতে সময় লাগে কয়েক মাস।
এরপর ২/৩ বছর সামান্য এলাকায় পানি জমলেও ২০১১ সালের পর থেকে যশোরের কেশবপুর ও মনিরামপুর এবং সাতক্ষীরার তালা উপজেলার ধানদিয়া, কুমিরিয়া, সরুলিয়া, ইসলাম কাঠি, মাগুরা ও তালা সদর ইউনিয়ন এবং কলারোয়া উপজেলার জয়নগর, দেয়াড়া, জালালাবাদ ও যুগিখালী ইউনিয়নের সব গ্রাম পানিতে তলিয়ে যায়। পানিতে তলিয়ে থাকা গ্রামগুলোর জনগণ ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নেয় অন্য এলাকায়। তবে বেশির ভাগ লোক আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে ঠাই করে নেন। যারা গত ২/৩ বছরেও তাদের বাড়ি ঘরে ফিরে যেতে পারেননি। এলাকাবাসী আরও জানায়, পদ্মা থেকে কপোতাক্ষ নদের উৎপত্তি হয়ে তা মিশেছে শিবসা নদীতে। ২০০৪ সালের আগ পর্যন্ত কপোতাক্ষ নদ স্বাভাবিক থাকলেও এ সময়ের পর থেকে আর পানি অপসারণ করতে সক্ষম হয়নি। ২০১২ সালের পর থেকে বর্ষায় জমে থাকা পানি নেমে যেতে সময় লেগেছে ৮ থেকে ৯ মাস। বছরের তিন চতুর্থাংশ সময় পানিতে নিমজ্জিত থাকায় আমন এবং অন্যান্য তরিতরকারি এখানে হয় না। দীর্ঘ দিন জলাবদ্ধ থাকার কারণে গবাদি পশু ও গাছপালা উজাড় হয়ে গেছে। ফসল ফলাতে কেশবপুর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দিয়ে পানি সেচে ফেলছেন এলাকাবাসী। তবে তা খুব বেশি কার্যকর নয় বলেও তারা জানিয়েছেন। একই পদ্ধতি অবলম্বন করে এবার কলারোয় উপজেলায় তিন শত বিঘা জমি চাষাবাদের আওতায় এনেছেন কৃষকরা। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, জোট সরকারের শেষ দিকে ৩৭ কোটি টাকা ব্যায়ে কপোতাক্ষ নদের খনন কাজ শুরু হয়। যশোরের কেশবপুর উপজেলা থেকে খনন কাজ শুরু হয়। খনন করা হয় তালা উপজেলা পর্যন্ত। তবে ড্রেজার মেশিন যথাযথভাবে কাজ করতে পারেনি। অনেক স্থানে ঢুকতে পর্যন্ত পারেনি। খনন করার সময় নদ থেকে উত্তোলন করা বালু ফেলা হয় একেবারেই নদের তীরে। যা পরবর্তী বর্ষা মৌসুমে আবারও নদের তলদেশ ভরাট করে ফেলে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌছায় যে শীতকালে কপোতাক্ষের অনেক স্থানে পায়ে হেটে পার হতে শুরু করেন এলাকাবাসী। একই সাথে ভূমি দস্যুরাও মেতে ওঠেন কপোতাক্ষের চর দখল প্রতিযোগিতায়। কপোতাক্ষ নদের দুই পাশে জেগে ওঠা চর দখলকারীদের মধ্যে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারাও রয়েছেন বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন। পাউবো সূত্রে আরও জানা যায়, চলতি বছর আবারও খনন কাজ শুরু হয়েছে। তবে এবার নীচু এলাকা হিসাবে তালা থেকে খনন কাজ শুরু করা হয়েছে। পাটকেলঘাটা পর্যন্ত কাজ হয়েছে। বর্ষা আসার আগে কলারোয়া পর্যন্ত খনন করার পরিকল্পনা রয়েছে। এজন্য সরকার সব ধরনের সহযোগিতা করবে। তালা উপজেলা চেয়ারম্যান ঘোষ সনৎ কুমার জানান, কপোতাক্ষ নদের পলি অপসারণ ও এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে সবাতœক চেষ্টা চালানো হচ্ছে। সরকারও আমাদের সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, আসন্ন বর্ষা মৌসুমে যেন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয় সে জন্য জোর প্রচেষ্টা চলছে। এ কাজে সরকারের কাছ থেকে আমরা সার্বিক সহযোগিতা পাওয়ার আশা রাখি। এলাকাবাসী আমাদের সাথে আছেন। ফলে আমরা দ্রুত কাজ করতে পারবো।