অর্থনীতি

দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি; মধ্যবিত্ত হচ্ছে নিম্নবিত্ত, নিম্নবিত্ত এখন দরিদ্র

By Daily Satkhira

February 20, 2022

অর্থনীতির খবর: একদিকে মহামারি করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রকোপ; অন্যদিকে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এই পরিস্থিতিতে দুই বছরের বেশি সময় ধরে চরম বিপাকে স্বল্প আয়ের মানুষগুলো। সম্প্রতি তেল-গ্যাসের দাম বাড়ায় আরও চাপে পড়েছেন তারা। গত সপ্তাহে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় মানুষগুলোর ওপর আঘাত করেছে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামহীন দামের কারণে অনেকে খাবার খাওয়ার পরিমাণও কমিয়ে দিয়েছেন। এরপরও টানতে পারছেন না খরচের লাগাম। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, অনেকের পক্ষে সংসারের খরচ চালানোই কষ্টকর হয়ে পড়েছে।

সরকারি হিসাবেই গত এক সপ্তাহে প্রায় সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত সপ্তাহের তুলনায় চলতি সপ্তাহে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৩ দশমিক ২৬ শতাংশ। খোলা আটার দাম ১ দশমিক ৪৫ এবং প্যাকেটজাত আটার দাম ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। প্যাকেট ময়দার দাম বেড়েছে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ৭ শতাংশ। পাম তেলের দাম বেড়েছে ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ। গত এক সপ্তাহে ডিম, চিনি, ব্রয়লার মুরগি, গরুর মাংস, জিরার দামও বেড়েছে বলে টিসিবির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

সরকারি প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক বছরে সরু চালের দাম ৪ দশমিক ৯২ এবং মোটা চালের দাম ৩ দশমিক ২৬ শতাংশ বেড়েছে। প্যাকেট আটার দাম বেড়েছে ২৭ দশমিক ৯৪ এবং খোলা আটার দাম বেড়েছে ১২ দশমিক ৯০ শতাংশ। ৩৫ দশমিক ২১ শতাংশ বেড়েছে খোলা ময়দার দাম।

এমন অস্বাভাবিক দাম বাড়ার তালিকায় রয়েছে সয়াবিন তেল ও পাম অয়েলও। এক বছরে খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ৩৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ, পাম তেলের দাম বেড়েছে ৩৯ দশমিক ১৫, বড় দানার মসুর ডালের দাম বেড়েছে ৪৪ দশমিক ৪৪, অ্যাংকর ডালের দাম বেড়েছে ১৫ দশমিক ২৯ ও পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ।

বাজারের চালচিত্র

টিসিবির প্রতিবেদনে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যে দাম দেখানো হয়েছে, বাস্তবে বাজারে সবগুলো পণ্য তারচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

টিসিবির প্রতিবেদনে মোটা চালের দাম ৪৫-৫০ টাকা দেখানো হলেও কার্যত বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৪ টাকায়। খোলা আটার দাম টিসিবির হিসাবে কেজি ৩৪ থেকে ৩৬ টাকা দেখানো হলেও বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩৮ থেকে ৪০ টাকায়। প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম টিসিবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ১৫৫ থেকে ১৬৫ টাকা, অথচ বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৬৫ থেকে ১৬৮ টাকা।

একইভাবে ১৫৫-১৫৮ টাকা বিক্রি হওয়া পাম তেলের দাম টিসিবির হিসাবে দেখানো হয়েছে ১৪৫-১৫০ টাকা। বাজারে দেশি পেঁয়াজের কেজি ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি হলেও টিসিবির প্রতিবেদনে দাম দেখানো হয়েছে ৪০-৫০ টাকা। ডিমের হালি টিসিবি ৩৬-৩৮ টাকা বললেও বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩৮-৪০ টাকায়।

টিসিবির প্রতিবেদনের সঙ্গে বাজারে ব্রয়লার মুরগি ও গরুর মাংসের দামেও ভিন্নতা পাওয়া গেছে। বাজারে ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৭০-১৭৫ টাকা বিক্রি হলেও টিসিবি বলছে ১৫০-১৬৫ টাকা। একইভাবে গরুর মাংসের কেজি ৬২০-৬৫০ টাকা হলেও টিসিবি বলছে ৬০০-৬২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

টিসিবির প্রতিবেদনে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাজারমূল্যের চেয়ে কম দেখানো হলেও এক বছরে সব ধরনের পণ্যের অস্বাভাবিক দাম বাড়ার তথ্য উঠে এসেছে। সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক বছর আগে কেজি ৫৮-৬৪ টাকায় বিক্রি হওয়া সরু চালের দাম এখন ৬০-৬৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মোটা চাল কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৫০ টাকা, যা এক বছর আগে ছিল ৪৪-৪৮ টাকা।

এক বছর আগে কেজি ৩৩-৩৫ টাকায় বিক্রি হওয়া প্যাকেট আটা ৪২-৪৫ টাকা এবং ৩০-৩২ টাকায় কেজি বিক্রি হওয়া খোলা আটার দাম ৩৪-৩৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খোলা ময়দা এক বছর আগে যেখানে ৩৫-৩৬ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে, এখন সেটা বিক্রি হচ্ছে ৪৬-৫০ টাকায়। প্যাকেট আটার দামও বেড়ে কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫২-৬০ টাকায়, যা এক বছর আগে বিক্রি হয়েছে ৪০-৪৫ টাকায়।

এমন অস্বাভাবিক দাম বাড়ার তালিকায় রয়েছে সয়াবিন তেল ও পাম অয়েলও। এক বছর আগে ১১৬-১২০ টাকা লিটার বিক্রি হওয়া খোলা সয়াবিন তেলের দাম এখন ১৫৫-১৬৫ টাকা। প্রতি লিটার পাম তেলের দাম বেড়ে হয়েছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা, যা এক বছর আগে ছিল ১০৫-১০৭ টাকা।

বড় দানার মশুর ডাল ৯৫-১০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে, যা এক বছর আগে ছিল ৬৫-৭০ টাকা। এক বছর আগে ৪০-৪৫ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া অ্যাংকর ডালের দাম এখন ৪৮-৫০ টাকা। আর দেশি পেঁয়াজের দাম এখন ৪০-৫০ টাকা, যা এক বছর আগে ছিল ২৫-৩৫ টাকা।

কষ্টের কথা বলতে গিয়ে ধরে আসছে গলা

সব ধরনের নিত্যপণ্যের এমন অস্বাভাবিক দামের কারণে কী ধরনের সমস্যার মধ্যে রয়েছেন, তা জানতে চাইলে স্বল্প আয়ের অনেকের গলা ধরে আসছে। রিকশাচালক মো. সাইফুর বলেন, ‘সারাদিন রিকশা চালিয়ে যে আয় করি, তা দিয়ে সংসার চলে না। কোনো রকমে ভাত-ভর্তা খেয়ে বেঁচে আছি।’

তিনি বলেন, ‘আমি রিকশা চালাই, স্ত্রী অন্যের বাসায় কাজ করে। আমাদের দুই সন্তান আছে। দুজন মিলে যে আয় করি তা ঘরভাড়া ও বাজার খরচের পেছনেই চলে যায়। মাস শেষে কোনো টাকা জমা থাকে না। চাল-ডাল কিছুটা কম দামে পাওয়ার আশায় আমার স্ত্রী টিসিবির ট্রাকের লাইনে দাঁড়ায়। কোনো দিন কিনতে পারে, কোনো কোনো দিন লাইনে দাঁড়িয়েও চাল-ডাল কিনতে পারে না। আমরা যে কী কষ্টে আছি, তা বলে বোঝাতে পারবো না। আমি নিজে দুপুরে খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। মাঝে মধ্যে কলা ও রুটি খেয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাটিয়ে দেই।’

পোশাককর্মী রুবিনা জানান, সংসার চালাতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। মালিবাগের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করা রুবিনা বলেন, ‘করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকেই আমরা বিপাকে আছি। এখন চাল, তেল, ডাল, পেঁয়াজ, ডিমের বাড়তি দাম আমাদের আরও কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বাজারে সবকিছুর আকাশছোঁয়া দাম। ৫০ টাকার নিচে সবজি কেনা যায় না।’

তিনি বলেন, ‘কয়েকদিন আগে ৩০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া পেঁয়াজ এখন ৫০ টাকা। চালের কেজি ৫০ টাকার ওপর। তেলের কেজি ১৬০ টাকার ওপর। সবকিছুর এত দাম হলে আমরা কিনবো কী করে? মাংস খাই না কতদিন হয়ে গেছে। বাজারে ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৭০ টাকা। মাসে যে বেতন পাই তার বেশিরভাগ চলে যায় ঘরভাড়ার পেছনে। চাল, ডাল, তেল কিনতেই বাকি টাকা শেষ হয়ে যায়। তিন কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে প্রতিদিন কাজে যাই। এরপরও বেশিরভাগ দিন দু’বেলার বেশি খাওয়া হয় না। মাঝে মধ্যে একবেলা খাই, তারপরও খরচের লাগাম টানতে পারছি না।’

শুধু সাইফুর বা রুবিনা নন, নিত্যপণ্যের এমন অস্বাভাবিক দামে এখন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ চরম বিপাকে পড়েছেন। মতিঝিলের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী মিজানুর রহমান বলেন, ‘প্রতি মাসে বেতন পাই ২৪ হাজার টাকা। বাসাভাড়া দিতে হয় ৯ হাজার টাকা। এর সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল মিলিয়ে মাসে সাড়ে ১০ হাজার টাকা চলে যায়। বাকি টাকা দিয়েই পুরো মাস চলতে হয়। চারজনের সংসারের চাল, ডাল, সবজি কিনতেই মাসে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা খরচ হয়।’

তিনি বলেন, ‘স্বল্প আয়ের মানুষ এখন অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্যে রয়েছে। তাদের দুঃখ-কষ্ট কেউ বুঝতে পারছে না। যদি বুঝতেই পারতো তাহলে জিনিসপত্রের দাম এমন অস্বাভাবিক হারে বাড়তো না। বাজারে এখন সবকিছুর দাম অস্বাভাবিক। কোনো কিছুর দামে নিয়ন্ত্রণ নেই। গত দু’দিনে পেঁয়াজ ও মুরগির দাম হুট করে বেড়ে গেছে। করোনার কারণে এমনিতেই আমাদের মতো স্বল্প আয়ের মানুষ কষ্টের মধ্যে রয়েছে। এখন জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে আমাদের কষ্ট আরও বেড়ে যাচ্ছে। অথচ জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে এখন বাজারে কোনো ধরনের অভিযান চলানোর খবর দেখতে পাই না। আসলে আমাদের কথা কেউ চিন্তা করে না।’

নিত্যপণ্যের এ মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে শুক্রবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) রংপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘ভোজ্যতেল, ডাল ও চিনির মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করছি। এসব পণ্য আমদানির পর ট্যারিফ কমিশন দাম নির্ধারণ করে। এরপরও কিছু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফার আশায় দাম বাড়িয়ে দেন। এজন্য জেলায় জেলায় দাম মনিটরিংয়ে ডিসিদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা মুনাফালোভী এসব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে।’

মধ্যবিত্ত হচ্ছে নিম্নবিত্ত, নিম্নবিত্ত হয়ে পড়ছে দরিদ্র

ঢাকা শহরে কী পরিমাণ মানুষ নিম্ন আয়ের তার কোনো জরিপ নেই। তবে পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১৪ সালে একটি বস্তিশুমারি করে। ওই শুমারির তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে মোট তিন হাজার ৩৯৪টি বস্তি রয়েছে। এসব বস্তিতে মোট ঘরের সংখ্যা প্রায় এক লাখ ৭৫ হাজার। আর বসবাসকারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় লাখ।

তবে বর্তমানে এ সংখ্যা আরও বেশি বলে ধারণা করা হয়। তাছাড়া নিম্ন আয়ের মানুষের একটি বড় অংশ বস্তির বাইরেও বসবাস করে। এর সঙ্গে ২০২০ শুরুতে দেখা দেওয়া করোনার প্রকোপের কারণেই মধ্যবিত্ত থেকে অনেকে নিম্নবিত্তের তালিকায় নেমে এসেছেন।

২০২০ সালের জুনে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক জরিপের তথ্য তুলে ধরে সংগঠনটির সভাপতি ড. আবুল বারকাত বলেন, লকডাউনের ৬৬ দিনে মধ্য-মধ্যবিত্তে থাকা তিন কোটি ৪০ লাখ থেকে এক কোটি দুই লাখ নিম্ন-মধ্যবিত্তে নেমেছেন। নিম্ন-মধ্যবিত্তে থাকা পাঁচ কোটি ১০ লাখ থেকে এক কোটি ১৯ লাখ দরিদ্র হয়েছেন। দরিদ্র থাকা তিন কোটি ৪০ লাখ থেকে দুই কোটি ৫৫ লাখ হতদরিদ্র হয়েছেন।

গত বছর এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্লাটফর্ম, বাংলাদেশ’র এক জরিপে উঠে আসে, কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের পর মানুষের আয় কমেছে ১৫ দশমিক ৮০ শতাংশ। বিপরীতে ব্যয় কমেছে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ। সঞ্চয় কমেছে ৬৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। আর কোভিড সমস্যার কারণে ৮০ দশমিক ৬০ শতাংশ পরিবারই খাদ্য গ্রহণ কমিয়ে দিয়েছে।