সাতক্ষীরা

সাতক্ষীরায় শিশু নির্যাতন বন্ধে আইনের দ্রুত প্রয়োগ ও মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে সচেতনতা তৈরির বিকল্প নেই !

By daily satkhira

March 25, 2022

এম. বেলাল হোসাইন: আইনের দ্রুত প্রয়োগ, মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করা এবং নির্যাতন বন্ধে ব্যাপক সচেতনা সৃষ্টি করতে পারলেই সাতক্ষীরায় শিশু নির্যাতন,ধর্ষনের মত ঘটনার প্রতিরোধ করা যাবে। তবে এক্ষেত্রে আইন শৃংখলা বাহিনীর পাশাপাশি ধর্মীয় নেতা, রাজনৈতিক নেতাসহ সামাজিক নেতৃবৃন্দকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মনে করেন সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ।

সম্প্রতি বেশ কয়েকটি লজ্জাজনক ঘটনায় সাতক্ষীরাবাসী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। জানা গেছে, ২০২০ সালে করোনার শুরু থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সাতক্ষীরায় ৩০৯ টি নারী ও শিশু ধর্ষনের শিকার হয়েছে। ধর্ষনের শিকার অধিকাংশই কন্যা শিশু। ধর্ষনের শিকার বয়স্ক নারীর সংখ্যা খুবই কম। করোনাকালিন সময়েই বেশি ধর্ষনের শিকার হয়েছে এ জেলার শিশুরা। এসব ঘটনা কন্যা শিশুদের ক্ষেত্রেই বেশি ঘটেছে। যাদের দ্বারা নির্যাতিত ও ধর্ষিত হয়েছে তারা সকলেই ভুক্তভোগীদের পরিচিত এবং আতœীয়। বেড়েছে শিশু শ্রম ও শিশু নির্যাতন। কন্যা শিশুর পাশাপাশিও অমানষিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে পুত্র শিশুও। গত ১৪ মার্চ ২০২২ সোমবার ৭বছরের শিশু আলিফকে রক্তাক্ত অবস্থায় মরিচ্চাপ নদীর বেড়িবাঁধের পাশে একটি পানি বিহীন পুকুরে পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করে।

আলিফকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে দুই চোখ খুচিয়ে – খুচিয়ে মারাত্মক ভাবে রক্তাক্ত জখম করা হয়। পুলিশ এঘটনায় রানী বেগম এবং আশিকুর কে আটক করে। রানী বেগম শিশুটি বড় মামী এবং আশিকুর তার ছোট মামা। শিশু আলিফের মা মারা যাওয়ার ছোটকাল থেকেই নানী বাড়িতে শিশু আলিফ। সে বড় মামীকেই মা বলে ডাকে। আটকের পর মামী রানী এবং আশিক জবানবন্দিতে বলেছে, তাদের দুজনের মধ্যে পরকীয়া ছিলো। ঘটনার দিন মামী রানী এবং আশিককে একই ঘরে দেখে ফেলে শিশু আলিফ। যে কারনে তার দুচোখে ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুচিয়ে নৃংশসভাবে হত্যার চেস্টা মামী রানী এবং মামা আশিক।

ওই নির্যাতনে শিশুটি তার ডান চোখ হারিয়েছে। এর কারণ হিসেবে সাতক্ষীরার বিশিষ্ট জনেরা বলেন নৈতিক শিক্ষা, আইন থাকলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকা, শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া, আদর্শ শিক্ষা না থাকা এবং অভিভাবকদের ব্যস্ততাও দায়ী। এছাড়া নৈতিক মূল্যবোধ দিন দিন কমে যাচ্ছে। স্বামী স্ত্রীর প্রতি দূরত্ব বাড়ার কারনে বেড়েই চলেছে পরকীয়ার মত ঘটনা। আর পরকীয়ার কারনেও অনেক শিশুকে নির্যাতনের পাশাপাশি জীবনও দিতে হচ্ছে। ধর্মীয় অনুশাসন না থাকাও এধরনের অপরাধ সংঘটিত হওয়ার কারণ হিসেবে মনে করছেন ধর্মীয় নেতারা। পাশাপাশি শিশুরা কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে, যিনি শিক্ষক তার নৈতিক চরিত্র কেমন হোক সে বয়স্ক বা যুবক।

সকল বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। অপরাধের বিষয়ে আইন থাকলেও যথাযথভাবে প্রয়োগ না হওয়াটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারন। কোন প্রভাবশালী ব্যক্তির কেউ অপরাধ করলে তার শাস্তি না হওয়াতে ওই অপরাধী আরো অপরাধে আসক্ত হয়ে পড়ে। আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ করতে হবে। দ্রুত রাষ্ট্রীয় আইন বাস্তবায়নের পাশাপাশি ধর্মীয় নেতাদের নিয়মিত এধরনের অপরাদের বিরুদ্ধে আলোচনা করতে হবে। বিশেষ করে মসজিদ মন্দির গীর্জায় এসব বিষয়গুলো নিয়ে বক্তব্য প্রদান করতে হবে।

পবিত্র কোরআনে কারিমে এ বিষয়ে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ।’ Ñ সুরা আল ইসরা : ৩২। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেন, ‘ব্যভিচার কোরো না’ এর তুলনায় আল্লাহর বাণী ‘ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না’ অনেক বেশি কঠোর। হাদিস দ্বারা ধর্ষণের শাস্তির বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়। হজরত ওয়াইল ইবনে হুজর (রা.) বর্ণনা করেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে এক নারীকে ধর্ষণ করা হলে রাসুলুল্লাহ (সা.) ওই নারীকে কোনোরূপ শাস্তি দেননি, তবে ধর্ষককে হদের (কোরআন-হাদিসে বহু অপরাধের ওপর শাস্তির কথা আছে। এগুলোর মধ্যে যেসব শাস্তির পরিমাণ ও পদ্ধতি কোরআন-হাদিসে নির্ধারিত তাকে ‘হদ’ বলে) শাস্তি দেন।’ Ñ ইবনে মাজাহ : ২৫৯৮। ধর্ষণের ক্ষেত্রে একপক্ষে ব্যভিচার সংঘটিত হয়। আর অন্যপক্ষ হয় নির্যাতিত। তাই নির্যাতিতের কোনো শাস্তি নেই। কেবল অত্যাচারী ধর্ষকের শাস্তি হবে।

হিন্দুধর্মীয় নেতা বৃন্দাবন ঠাকুর তার রচিত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যদি কন্যা সকামা(মহিলা যদি নিজের ইচ্ছায়) হয় তবে বধদন্ড(মৃত্যুন্ড) হইবেনা।। অর্থাৎ, কোনো মহিলার অনিচ্ছায় যদি যৌনসঙ্গম করা হয় তবে সেটা ধর্ষণ, আর তার শাস্তি হবে লিঙ্গ কেটে ফেলা বা মৃত্যু দন্ড। আর যদি মহিলা স্বইচ্ছায় যৌনসঙ্গম করে যাকে ব্যাভিচার বলা হয়,তবে গমনকারী ব্যাক্তির মৃত্যুদন্ড হবেনা। কারণ এখানে উভয়ের ইচ্ছা ছিলো।

সাতক্ষীরার বিশিষ্ট ও কবি স ম তুহিন বলেন, আমরা দিন দিন আমাদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। একটা সময়ে বিকালে মাঠে লাঠি খেলা, যাত্রাপালা, জারিগান, কাবাডি খেলা, ওয়াজ মাহফিল, পালাগান হত। সেখানে ছোট বড় সকল বয়সী মানুষের উপস্থিতি থাকতো। প্রচুর দর্শকও থাকতো। এখন এগুলো তেমন দেখা যায় না। শিশুরা টিচার, স্বজন এবং ধর্মীয় নেতা দ্বারা ধর্ষিত হচ্ছে। এর কারন আমাদের লেখাপড়াটার উদ্দেশ্যেটার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু একটা সময় পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার উদ্দেশ্যেই লেখাপড়া করা হতো। আদর্শিত মানুষ হওয়ার জন্য লেখাপড়া করা হতো। নৈতিক শিক্ষা থেকে দূরে চলে যাচ্ছি আমরা। ধর্মীয় অনুশাসন মানার কারনেও মানুষ অপরাধ থেকে দূরে থাকতো। এখন ধর্মীয় অনুশাসন আর তেমনটা দেখা যায় না। অভিভাবকদের সচেতনতাও অনেকাংশে দায়ী। এসব অপরাধ দমনে অভিভাবকদের আরো বেশি সচেতন হতে হবে। শিশুদের বেশি বেশি সময় দিতে হবে। ব্যাট টার্চ ও গুড টার্চ সম্পর্কে ধারনা দিতে হবে। অন্যদিকে অযোগ্য জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচিত করাটাও একটি অন্যতম কারন। তারা ভোটের জন্য এসব অপরাধকে ধামা চাপা দিতে চান। এমনকি কোন কোন সময়ে নিজেরাইও এধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েন।

সাতক্ষীরা মহিলা অধিদপ্তরের উপ পরিচালক এ কে এম শফিউল আযম বলেন, মহিলা অধিদপ্তর, সাংবাদিক প্রশাসন সকলেই কিন্তু বাল্য বিবাহ এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে। তারপরও কিছু ঘটনা ঘটছে, মূলত অভিভাকদের অসচেতনতা এবং জনপ্রতিনিধিদের সদিচ্ছার অভাব থাকার কারনেই এধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। তবে বাল্য বিবাহের পরেও মামলা করার সুযোগ রয়েছে। যে কেউ বাদী হয়ে মামলা করতে পারবে। সাতক্ষীরা জজকোর্টের অতিরিক্ত পিপি এ্যাড. ফাহিমুল হক কিসলু বলেন, আইনের দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিচার প্রার্থীরা ধর্য্য হারা হয়ে যায়। ফলে আসামীরা পার পেয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে দ্রুত বিচার করতে হবে। সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে, বিচারপ্রার্র্থীর হয়রানি বন্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। সর্বপরি মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে পারলেই এসব অপরাধ পুরোপুরি বন্ধ করতে না পারলেও প্রতিরোধ করা সম্ভব।

সাতক্ষীরা মায়ের বাড়ি মন্দিরের পুরোহিত শ্যামল চক্রবর্তী বলেন, এধরনের কাজ খুবই ন্যাক্কার জনক, মহাপাপ। এধরনের কাজের সাথে যারা জড়িত তাদের নরকে কঠোর শাস্তি পেতে হবে। এগুলো প্রতিরোধে তিনি মন্দিরের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে বেশি বেশি করে মহাপাপ কাজ থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি পরলোকের কঠোর শাস্তির বিষয়টি নিয়ে ভক্তদের মধ্যে আলোচনা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

সাতক্ষীরা আলিয়া কামিল মাদ্রাসার মুহাদ্দিস সামছুজ্জামান বলেন, পবিত্র কোরআনে এ সংক্রান্ত অনেক আয়াত রয়েছে। মসজিদের ইমামদের বেশি বেশি খুতবার এসব আয়াত নিয়ে আলোচনা করতে হবে। মানুষকে পরকালের শাস্তির বিধান সম্পর্কে অবগত করাতে হবে। তাহলেই এধরনের অপরাধ কমানো সম্ভব।