আন্তর্জাতিক

নবীকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য : মধ্যপ্রাচ্যে কূটনৈতিক সংকটে ভারত

By Daily Satkhira

June 07, 2022

বিদেশের খবর: নবী হযরত মুহম্মদকে (সা.) নিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির দুই নেতার বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক টানাপোড়েন প্রকট হচ্ছে।

উপসাগরীয় দেশ কাতার, কুয়েত, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ওমান, বাহরাইনের পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, মালদ্বীপ, জর্ডান, লিবিয়াও ভারতের ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেছে।

কুয়েতের বাজারে ভারতীয় পণ্য বর্জন করা হয়েছে। ইরান, কুয়েত এবং কাতার ওই ঘটনায় নিন্দা জানাতে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে। সৌদি আরব সমালোচনা জানিয়ে কড়া ভাষায় বিবৃতি দিয়েছে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স লিখেছে, উপসাগরীয় এবং এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ এ মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর সঙ্গে নয়া দিল্লির সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকায় ভারতীয় কূটনীতিকরা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেও ঝড়ের যে আরও অনেকখানি বাকি তা টের পাওয়া যাচ্ছে।

এই বিতর্কের মূলে রয়েছেন নূপুর শর্মা, যিনি ছিলেন ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপির মুখপাত্র। গত মাসে এক টেলিভিশন বিতর্কে তিনি নবীকে নিয়ে বিতর্কিত ওই মন্তব্য করেছিলেন। তার সেই বক্তব্যের ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে।

বিজেপির দিল্লি শাখার মিডিয়া প্রধান নভিন কুমার জিন্দালও বিতর্কিত এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে টুইটারে উসকানিমূলক পোস্ট দেন।

তাদের এসব মন্তব্যকে ভারতে বিদ্যমান তীব্র ধর্মীয় বিভাজনের প্রতিফলন বলছেন সমালোচকরা। এই বিভাজন দেশটি গত কয়েক বছর ধরেই প্রত্যক্ষ করে আসছে। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ও আক্রমণ তীব্রভাবে বেড়েছে।

দুই বিজেপি নেতার, বিশেষ করে নূপুর শর্মার বক্তব্য ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়কে ক্ষুব্ধ করেছে। কিছু রাজ্যে বিচ্ছিন্নভাবে বিক্ষোভও দেখা গেছে।

বিজেপির এই দুই নেতা এরই মধ্যে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন। নূপুরের সদস্যপদ স্থগিত এবং জিন্দালকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

এর পাশাপাশি এক বিবৃতিতে বিজেপি বলেছে, “বিজেপি যেকোনো ধর্মের যেকোনো ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে অপমানের কঠোর নিন্দা জানায়। কোনো সম্প্রদায় বা ধর্মকে অপমান বা হেয় করে- এমন যেকোনো আদর্শেরও বিরুদ্ধেও বিজেপি। বিজেপি এ ধরণের মানুষ কিংবা দর্শনকে সমর্থন করে না।”

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় যেভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গেছে তাতে বিজেপির নেওয়া এ পদক্ষেপ হয়ত যথেষ্ট বলে বিবেচিত হবে না।

ভারতকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বলেছে কাতার। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, “এ ধরনের ইসলামবিদ্বেষী মন্তব্যের জন্য যদি শাস্তি পেতে না হয়, এটি যদি অব্যাহত থাকে, তবে তা মানবাধিকারের জন্য গুরুতর হুমকি হবে। এর মাধ্যমে বিদ্বেষ ও বিভাজন আরও বাড়বে, যা সংঘাত ও ঘৃণার চক্র তৈরি করবে।”

সৌদি আরবও তাদের বিবৃতিতে কড়া কড়া শব্দ ব্যবহার করেছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, বিজেপির মুখপাত্রের বক্তব্যের নিন্দা জানাচ্ছে তারা।

পরিস্থিতি সামাল দিতে কূটনীতিকদের মুখ খুলতে হচ্ছে।

কাতারে ভারতের রাষ্ট্রদূত দীপক মিত্তাল বলেছেন, ‘বিচ্ছিন্ন কিছু ব্যক্তির’ মন্তব্য ভারত সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করে না। বিজেপির সিনিয়র নেতা এবং অন্যান্য কূটনীতিকরাও বিতর্কিত সেই বক্তব্যের নিন্দা করেছেন।

বিতর্কিত ওই মন্তব্যের জেরে ৫৭ সদস্যের অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স (ওআইসি) এবং পাকিস্তানও ভারতের সমালোচনা করেছে। দিল্লি অবশ্য ওআইসি ও পাকিস্তানের সমালোচনাকে উড়িযে দিয়েছে। বলেছে, তাদের মন্তব্য ‘অবাঞ্ছিত ও সংকীর্ণচিত্তের’।

বিশ্লেষকরা বলছেন, জল অনেকদূর গড়িয়ে গেছে। পরিস্থিতি সামলাতে এখন বিজেপি ও সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বকে প্রকাশ্যে বিবৃতি দেওয়া লাগতে পারে। তা না হলে আরব বিশ্ব ও ইরানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

সংকটে অনেক কিছু :

উপসাগরীয় দেশগুলোর জোট গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) সদস্য কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব, বাহরাইন, ওমান এবং ইউএই। এই জোটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে ভারতের। ২০২০-২০২১ সালে জিসিসির সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৮৭ বিলিয়ন ডলার।

এসব দেশে লাখ লাখ ভারতীয় কাজ করে, যারা কোটি কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠায় দেশে। ভারতের সবচেয়ে বেশি জ্বালানি আমদানিও হয় এসব দেশ থেকেই।

২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে উপসাগরীয় অঞ্চলে নিয়মিত সফর করতে দেখা গেছে। ভারত সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে ভারত একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সই করেছে, ব্যাপক বাণিজ্য চুক্তির জন্য জিসিসির সঙ্গে তাদের আলাপও চলছে।

নরেন্দ্র মোদী ২০১৮ সালে আবুধাবিতে প্রথম হিন্দু মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন; একে ভারতের সঙ্গে উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের নজির বলে অভিহিতও করেছিলেন।

নবীকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া দেশগুলোর তালিকায় আরব আমিরাতের নাম থাকা নয়া দিল্লির জন্য ‘খুবই দুশ্চিন্তার’, বলছেন বিশ্লেষকরা।

গত কয়েক বছরে আরব আমিরাতের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। দেশটি বহুজাতিক বিভিন্ন ফোরামে ভারতকে সমর্থনও করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যে বিতর্ক শুরু হয়েছে তা আরব আমিরাত এবং অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক সাফল্যে ছায়া ফেলতে পারে।

কয়েক বছরে দিল্লির সঙ্গে তেহরানের সম্পর্কে আগের মতো উষ্ণতা নেই। এর মধ্যে এই বিতর্ক ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ানের আসন্ন ভারত সফরেও প্রভাব ফেলতে পারে।

ভারতের প্রাক্তন কূটনীতিক অনিল ত্রিগুনায়াত আরব বিশ্বে কাজ করেছেন। তার ভাষ্য, ভারত এখন জটিল পরিস্থিতিতে আছে, এবং কেবল নেতৃত্ব পর্যায়ে আন্তরিক প্রচেষ্টাই ভারতের নেতিবাচক পতন রোধ করতে পারে।

এক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে ভারতকে যে কূটনৈতিক মূল্য দিতে হবে, তাতে উপসাগরীয় অঞ্চলে ভারতের স্বার্থের বিশাল ক্ষতি করতে পারে, বলছেন অন্য কূটনীতিকরাও।

উইলসন সেন্টারের এশিয়া কর্মসূচির পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, বিদেশি রাষ্ট্র এমনকি দিল্লির ঘনিষ্ঠ কেউও যখন ভারতের কোনো অভ্যন্তরীণ বিষয়ের সমালোচনা করেন, তখন ভারতীয় কর্মকর্তারা প্রায়শই আত্মপক্ষ সমর্থন করে প্রতিক্রিয়া দেখান।

“কিন্তু এই ক্ষেত্রে ভারতীয় কূটনীতিকরা ক্ষমা প্রার্থনা থেকে শুরু করে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে নানা কৌশল অবলম্বন করতে পারেন,” বলেছেন তিনি।

আরব দেশগুলোও নিজ দেশের জনগণের মধ্যে ক্ষোভ কমানোর উপায় খুঁজছে। এসব দেশে ভারতের সমালোচনা করে দেওয়া হ্যাশট্যাগগুলো ট্রেন্ড হচ্ছে, দেশগুলোর গণমাধ্যমেও নবী মোহাম্মদকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের ইস্যুটির খবর নিয়মিত আসছে।

এর মধ্যে কিছু হ্যাশট্যাগে ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দেওয়া হয়েছে। কাতার ও কুয়েতের অনেক দোকান তাদের তাক থেকে ভারতীয় পণ্য সরিয়ে নিয়েছে বলেও খবর পাওয়া গেছে।

কুগেলম্যানসহ অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জিসিসির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ এবং উভয় পক্ষই উত্তেজনা কমানোর দিকে মনোযোগ দেবে।

“কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চলের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে। অবশ্য ভারত তার শক্তিশালী অবস্থান ও প্রভাবের কারণেও নিজেকে কিছুটা রক্ষা করতে পারবে।

“নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থেই উপসাগরীয় দেশগুলো চাইবে ভারত তাদের কাছ থেকে জ্বালানি কিনুক, তারা চাইবে ভারতীয়রা থাকুক, কাজ করুক। সর্বোপরি তারা ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে যেতে চাইবে,” বলেছেন তিনি।

ধর্মীয় বিভাজন বাড়ছে :

সমালোচকরা বলছেনে, বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতে ধর্মীয় মেরুকরণ বাড়ছিল। তার মধ্যে শতাব্দী প্রাচীন একটি মসজিদে প্রার্থনার অনুমতি চেয়ে বারানসীর স্থানীয় আদালতে হিন্দুদের কয়েকটি দলের আবেদনকে ঘিরে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে উত্তেজনাও ছিল চরমে।

যে মসজিদে প্রার্থনার আবেদন জানানো হয়েছিল, সেটি একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ওপর নির্মিত হয়েছিল বলে দাবি করে আসছেন কট্টরপন্থি হিন্দুরা।

এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে টিভি চ্যানেলগুলো উস্কানিমূলক বিতর্কের আয়োজন করেছে; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিস্তর বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা দেখা গেছে। ডানপন্থি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত অনেকে বিভিন্ন টিভি শোতে বিতর্কিত বক্তব্যও দিয়েছেন।

সমালোচকরা বলছেন, বিজেপি দাবি করলেও নূপুর শর্মা মোটেও ‘বিচ্ছিন্ন কেউ’ নন। তিনি দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত মুখপাত্র ছিলেন, যার কাজ ছিল বিজেপির দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা।

বিষয়টি নিয়ে এই আন্তর্জাতিক টানাপোড়েন ভারতের জন্য ‘জেগে ওঠার’ বার্তা হওয়া উচিত; বিভাজনের রাজনীতি যে আন্তর্জাতিক জটিলতায়ও ফেলতে পারে, তাও তাদের শেখা উচিত, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

“ক্রমবর্ধমান বিষাক্ত রাজনীতির ক্ষেত্রে, ভারতে যা ঘটে, সবসময়ই যে তা ভারতের ভেতরেই থাকে না, দিল্লি তা শিখছে। বিশ্বব্যাপী ভারতের যখন প্রভাব বাড়ছে, বিদেশে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব আরও শক্তিশালী হচ্ছে; তখন অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বিদেশের অসন্তোষের কারণ হলে ঝুঁকি বাড়বে,” বলেছেন কুগেলম্যান।