সব কিছু ঠিক থাকলে চলতি জুনেই পিলারের ওপর বসানো হবে স্প্যান (দুই পিলারের সঙ্গে সংযোগ অবকাঠামো)। আর তখনই দৃশ্যমান হবে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর নির্মাণ কার্যক্রম। তবে কবে নাগাদ স্প্যান বসবে, তা এখনও ঠিক করা হয়নি। চেষ্টা চলছে চলতি জুন মাসের যেকোনও দিন বসানোর। বিষয়টি নির্ভর করছে আবহাওয়া, নদীর গতি প্রকৃতির ওপর। সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম এমন তথ্য জানিয়েছেন। প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘আমরা দিনরাত কাজ করছি। এতে কোনও গাফিলতি নেই। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এ সেতুর কাজ শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে মাঠে আছি।’
জানতে চাইলে শফিকুল ইসলাম জানান, ‘দ্বিস্তর বিশিষ্ট পদ্মা সেতুর স্প্যানের ওপর বসানোর জন্য স্ল্যাব নির্মাণের কাজ গত দুই সপ্তাহ আগে শুরু হয়েছে। মোট তিন হাজার স্ল্যাব বসানো হবে। এই স্ল্যাবের ওপর বিটুমিন দেওয়া হবে। এটির ওপর দিয়েই যানবাহন চলবে। পদ্মা নদীতে আরও অপেক্ষা করছে ৪ হাজার টন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ক্রেন। যেটির কাজ হবে স্প্যানগুলোকে দুই পিলারের ওপর বসিয়ে দেওয়া। চলতি মাসে স্প্যান বসানোর কাজ শুরু হলেই পদ্মা সেতুর কাজের অগ্রগতি সবাই দেখতে পাবেন।’ তিনি জানান, ‘মে পর্যন্ত এই প্রকল্পের কাজ ৪২ শতাংশ শেষ হলেও মূল কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ। রোজার ঈদের সময় কাজের গতি হয়তো সামান্য কিছুটা কমবে, কারণ শ্রমিকরা অনেকেই বাড়ি যাবেন। তবে তা যেন কোনোভাবেই বেশি সময় না নেয়, এ জন্য আমাদের পক্ষ থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলা হয়েছে।’
প্রকল্প দফতরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদ্মা সেতুর শরীয়তপুরের জাজিরার নাওডোবা থেকে মাদারীপুরের কাওড়াকান্দি পর্যন্ত দৈর্ঘ সাড়ে ১০ কিলোমিটারের বেশি অংশে অ্যাপ্রোচ সড়ক, ৫টি সংযোগ সেতু, ৮টি আন্ডারপাস ও ২০টি কালভার্ট নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে।
চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পটির জাজিরা প্রান্তে অ্যাপ্রোচ রোডের কাজ শতকরা হিসেবে ৯৫ শতাংশ, মাওয়া প্রান্তে অ্যাপ্রোচ রোডের কাজ ১০০ শতাংশ, সার্ভিস এরিয়া-২-এর কাজ ১০০ শতাংশ, নদীশাসন কাজ ৩০ শতাংশ শেষ হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রকল্পটির জন্য সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার ৬৭৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। এর মধ্যে গত এপ্রিল পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ১৯৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, যা আরএডিপি বরাদ্দের ৪৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ। আগামী অর্থবছর (২০১৭-১৮) এ প্রকল্পে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৫২৪ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আব্দুল কাদের জানান, ‘এ পর্যন্ত ৪২ দশমিক ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হলেও এর অগ্রগতি বোঝা যায় না। কারণ, প্রকল্পের বেশিরভাগ কাজই হয়েছে পাইলিংয়ের কাজ। যা মাটির নিচে। পুরো সেতুতে ৪০টি স্প্যান বসবে। এর মধ্যে ২০টি প্রস্তুত রয়েছে। যার একটিও বসানো হয়নি। যে সুপার স্ট্র্যাকচারগুলো তৈরি হয়েছে, তা কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে প্যানেল করে রাখা আছে। ২০ টি স্প্যানের মধ্যে প্রকল্প সাইডের মাওয়া প্রান্তে আছে ৭টি, বাকি ১৩টি এখনও চীন থেকে আনা হয়নি। স্প্যানগুলো চীনের চিন হোয়াং ডক থেকে জাহাজে সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। সেখান থেকে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের পর মাওয়ায় এসে পৌঁছাতে মোট সময় লাগে ২৮ দিন। কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে স্থান সংকুলানের কথাও আমাদের চিন্তা করতে হয়। তাই তৈরি স্প্যানগুলো এখনও চীনে আছে। বসানোর কাজ শুরু হলে পর্যায়ক্রমে আনা হবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদ্মা সেতুর কাজের গতি বাড়ানোর জন্য অতিরিক্ত একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন হ্যামার আনার প্রক্রিয়া চলছে। বর্তমানে যে দু’টি হ্যামার দিয়ে পাইলিংয়ের কাজ হচ্ছে, এগুলোর ক্ষমতা যথাক্রমে ২ হাজার ৪০০ ও ২ হাজার কিলোজুল। আর নতুন যে বিশাল আকৃতির হ্যামারটি জুন মাসের ১০ তারিখে সেতুর পাইলিংয়ের কাজে যুক্ত করা হবে, তার ক্ষমতা ৩ হাজার কিলোজুল। এতে দ্রুত গতিতে পদ্মা সেতুতে পাইলিংয়ের কাজ করা যাবে।
এদিকে দেওয়ান আবদুল কাদের জানান, ‘গত এপ্রিল মাস পর্যন্ত পদ্মা সেতুর কাজের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৮ শতাংশ। কিন্তু কাজ হয়েছে ৪২ দশমিক পাঁচ শূন্য শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা থেকে কিছুটা পিছিয়ে পড়ার কারণে কাজের গতি বাড়াতে হবে, যদি ঠিক সময়ে কাজটি সম্পন্ন করতে চাই। সেই লক্ষ্যে একটি নতুন হ্যামার আনা হবে। আর এখন যেখানে ৬টি কপার ড্রামে কাজ চলছে, তার পরিবর্তে ১৩টি প্লাটফরমে কাজ করা হবে। তখন কাজের অগ্রগতি হবে।’
পদ্মা সেতু প্রকল্পের মাওয়া প্রান্তে ১ দশমিক ছয় সাত কিলোমিটার মেইন রোড ও দুই কিলোমিটার লিংক রোডের কাজ গত বছরের জুলাই মাসে শেষ হয়েছে। জাজিরা প্রান্তে ১০ দশমিক পাঁচ সাত কিলোমিটার (প্রায়) মেইন রোড, ৩ কিলোমিটার লিংক রোড, ১২ কিলোমিটার সার্ভিস রোড ও ৬ কিলোমিটার ফেরি শিফটিং রোডের কাজ শেষ হয়েছে প্রায় ৯৮ শতাংশ। নির্বাহী প্রকৌশলী ( অ্যাপ্রোচ রোড) সৈয়দ রজব জানান, ‘গত ডিসেম্বর মাসেই অ্যাপ্রোচ রোডের কাজ ৮৫ শতাংশ শেষ হলেও গত পাঁচ মাসে ধীর গতিতে বাকি ১৩ শতাংশ কাজ করতে হয়েছে। কারণ মাটি সেটলম্যান্টের ব্যাপার আছে। এছাড়া, সেতুর দুই প্রান্তে থানা তৈরির কাজও করে দেওয়া হয়েছে।’
প্রকৌশলী দেওয়ান কাদের জানান, ‘এই সেতু প্রকল্পে দেশি-বিদেশি মিলে প্রায় চার হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। তবে এই সংখ্যা কিছুটা ওঠানামা করে। প্রায় ৮ শ বিদেশি শ্রমিকের মধ্যে চীনাদের সংখ্যাই বেশি। তাদের মধ্যে প্রায় ৫০০ শ্রমিকসহ প্রজেক্ট ম্যানেজার ও ম্যানেজম্যান্ট লেভেলের কর্মকর্তা রয়েছেন।’