ফিচার

দক্ষিণবঙ্গের আজব যান হেলিকপ্টার : রাজপথে বিমানের ছোঁয়া

By daily satkhira

July 09, 2022

আচ্ছা আপনি কি কখনো দ্বিচক্রযান হিসেবে হেলিকপ্টারকে কল্পনা করে দেখেছেন? যে হেলিকপ্টার আকাশে ওড়ে না বরং রাস্তায় চলে! কী ভাবছেন? সড়কপথে হেলিকপ্টার তাও দ্বিচক্রযান, মশকরা নাকি? না মোটেও মশকরা নয়। এমন হেলিকপ্টারের দেখা মিলবে দক্ষিণবঙ্গের জেলা সাতক্ষীরায়।

বাংলাদেশের একমাত্র জেলা সাতক্ষীরা যেখানে হেলিকপ্টার রাস্তায় চলে। এই হেলিকপ্টার হচ্ছে বাই সাইকেলেত পিছনের ক্যারিয়ারে ফোম বা গদি বেঁধে আরেকজনকে বসানোর এক অভিনব ব্যবস্থা। এই হেলিকপ্টারের জন্য “হিরো রিয়েল” বাইসাইকেলের ব্যবহার ছিল বেশি। কেননা এটি অন্যান্য সাইকেলের তুলনায় মজবুত এবং হিরো রিয়েলের ক্যারিয়ার ছিল অপেক্ষাকৃত বড়। সাইকেলের ক্যারিয়ারে স্ক্রুর সাহায্যে কাঠের তক্তা আটকানো হতো এবং তার ওপরে বসানো হতো গদি বা ফোম। এই গদি বা ফোমে সাধারণত এক বা দুজন মানুষকে বহন করার ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এই হলিকপ্টার মূলত ভাড়ায় চালিত যান আর এর চালককে “পাইলট” অভিহিত করা হতো।

হেলিকপ্টারের যথার্থ কোনো ইতিহাস জানা যায় না। তবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অন্যতম উপন্যাস “পূর্ব-পশ্চিম” এ সুনীল সাতক্ষীরা অঞ্চলের কথা লিখতে গিয়ে হেলিকপ্টার সম্পর্কে একটি কথিত গল্পের অবতারণা করেছিলেন। কোনো এক ধনাঢ়্য ব্যবসায়ী সাতক্ষীরা অঞ্চলে এসেছিলেন ব্যবসায়ের প্র‍য়োজনে। তখন বৃষ্টি কাদার সময়। রাস্তাঘাট ডুবতে বসেছে। সাতক্ষীরা অঞ্চলের জমিদার সেই ব্যবসায়ীকে আপ্যায়নের উদ্দ্যেশ্যে বাইসাইকেলের ক্যারিয়ার সুসজ্জিত করে তার কর্মচারীকে পাঠান তাকে নিয়ে আসার জন্য এবং এর নামকরণ করেন হেলিকপ্টার। হেলিকপ্টারের উদ্ভাবন ঠিক কার হাত ধরে হয়েছিল তা বলা মুশকিল। তবে কথিত আছে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার জনৈক ব্যক্তি এটি উদ্ভাবন করেন।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ এই বছর পঞ্চাশেক আগেও বাংলাদেশের অন্যতম উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার অধিকাংশ রাস্তাঘাটই ছিল অনুন্নত। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ছিল না কোনো পাকা রাস্তা। নিচু কাচা রাস্তায় সামান্য বৃষ্টি হলেই উঠে যেত পানি। অত্যন্ত কাদার কারণে কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারত না। ঠিক এরকম প্রেক্ষাপটে বাণিজ্যিকভাবে চালু হয় হেলিকপ্টার সার্ভিস। তৎকালীন সময়ে সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকায় কথিত ছিল – “হেলিকপ্টার রাজপথে বিমানের ছোঁয়া”। সত্তর আশির দশকে সাতক্ষীরায় এসেছেন অথচ হেলিকপ্টারে চড়েন নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়।

শুধুমাত্র প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষ বহনই নয়, সংবাদপত্র পৌঁছানোর কাজেও সহায়ক ভূমিকা রাখত এই হেলিকপ্টার। হকাররা হেলিকপ্টার ব্যবহার করে সুন্দরবনসংলগ্ন শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দিতেন সংবাদপত্র। সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ, আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলায় হেলিকপ্টারের প্রচলন ছিলো সবচেয়ে বেশি। হেলিকপ্টারে যাতায়াত আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত ছিল এ অঞ্চলে। সাতক্ষীরা অঞ্চলের বহু বেকার যুবক ও বৃদ্ধ বাইসাইকেল হেলিকপ্টার চালিয়ে উপার্জন করেছেন অর্থ, চালিয়েছেন সংসার, করেছেন ক্ষুধার নিবৃত্তি। বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে বাইসাইকেল হেলিকপ্টার অনেকের কাছে হাস্যরসের সঞ্চার ঘটালেও তৎকালীন সময় ও যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে হেলিকপ্টার ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি বাহন।

বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি আর যুগের হাওয়া বদলে বিলুপ্তি ঘটেছে বাইসাইকেল হেলিকপ্টারের। তবে এর বদলে চালু আছে মোটরসাইকেল হেলিকপ্টার।বর্তমানে জেলাবাপী প্রায় ১৫হাজার মোটরসাইকেল চালক মোটরসাইকেল হেলিকপ্টার ব্যবস্থাটি চালু রেখেছে।

লেখা : অনুস্কা ব্যানার্জী, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়