কলারোয়া

প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা আছে, সমতা ও স্বস্তি নেই…সংসদে মুস্তফা লুৎফুল্লাহ এমপি

By Daily Satkhira

June 13, 2017

আজ বুধবার জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেট এর উপর আলোচনা করেন সাতক্ষীরা-০১ আসনের সংসদ সদস্য মুস্তফা লুৎফুল্লাহ। তিনি তার বক্তৃতায় সাতক্ষীরা বাইপাস সড়ক, সাতক্ষীরার স্বাস্থ্য সেবার অরাজকতা, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, সমতা প্রভৃতি বিষয় তুলে ধরেন। পাঠকদের জন্য তার বক্তৃতার সার সংক্ষেপ এখানে উপস্থাপান করা হলো- মাননীয় স্পিকার,  আপনাকে ধন্যবাদ। একথা সত্য যে, বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় মাত্রায় উন্নতি করেছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে, অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক গতি এসেছে, বৈদেশিক মুদ্রার বড় রিজার্ভ সৃষ্টি করা গেছে, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর মতো বৃহত্তম উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে, সার্বিক অর্থনীতিতে জোয়ারের ¯্রােত, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বিশ^কেও তাক লাগিয়েছে। কিন্তু উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির এই স্বর্ণসময়েও বৈষম্য কমেনি বরং বেড়েছে। উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির স্বর্ণদুয়ার খুলেছে যে কৃষক-শ্রমিকের শ্রমে-ঘামে, তারাই এখনও ওই দুয়ার দিয়ে হাঁটার সুযোগ পাননি। বরং এই শ্রমজীবী মানুষের শ্রম-ঘাম ব্যবহার করে গুটিকতক মানুষ সব মুনাফা লুটে নিচ্ছে। আয় বৈষম্য বাড়ছেই দিনে দিনে। নব্বই থেকে পঁচানব্বই শতাংশ সাধারণ মানুষের সম্পদের সমপরিমাণ সম্পদ ভোগ করে হাতেগোনা পাঁচ থেকে দশ শতাংশ ধনী মানুষ। এই বৈষম্য ঘুচিয়ে সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজটি করতে না পারলে উন্নয়ন ফাঁপা বেলুনে পরিণত হবে। ফটকাবাজির আলোকচ্ছটায় সাময়িক চোখ ধাধালেও মুহূর্ত পরেই তা অন্ধকারে পরিণত হবে। তবে বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা দুর্নীতি। সারাবছর কাজ না করে অর্থবছরের শেষ এক মাসে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের অনিয়ন্ত্রিত ভেলকিবাজি এখানে ফি-বছরের। সেইসাথে লুটপাটের গণউৎসবও চলে। এই দুর্নীতি-লুটপাট নিয়ন্ত্রণ করে বাজেট বাস্তবায়নে আরো গতি আনতে পারলে উন্নয়ন আরো অনেকখানি কাজে আসবে। সাধারণ মানুষের উপর বিশাল করের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এ ক্ষেত্রেও প্রত্যক্ষ করের চাইতে অপ্রত্যক্ষ করের উপর একটি বড় নির্ভরশীলতা রয়েছে। আর অপ্রত্যক্ষ করের বোঝা খুব স্বাভাবিকভাবেই নি¤œবিত্ত-মধ্যবিত্তমানুষের নিত্যদিনের জীবনে হাঁসফাঁস তুলে দেয়। বরং দেশে কর প্রদানের মতো সমর্থ্যবানরাই কর চুরি করে। সব পণ্যে গণহারে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করবে সরকার। সামর্থ্যবান মানুষদের কাছ থেকে আয় ও মুনাফার ওপর কর আদায় করা হয়। বিপরীতে ধনী-গরিব নির্বিশেষে দেশের সব মানুষকে একই হারে ভ্যাট দিতে হয়। এই অপ্রত্যক্ষ করের চাপ নিতে গিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা আরো কঠিন হবে।

মাননীয় স্পিকার, মাননীয় অর্থমন্ত্রী চেয়েছেন দেশের সর্বাঙ্গীন স্বস্তি। আর তা করতে গিয়ে তিনি আপাত এতো বেশি অস্বস্তিতে ফেলেছেন যে তা চিন্তারও বাইরে। এতো এতো কর, এতো এতো ভ্যাট! কথা বলার করের হার (মোবাইল ফোনের বিলের ওপর) তো গত বছরই বাড়িয়েছেন, এবার ফোনের দামও বাড়ালেন। করের জাল থেকে মুক্তি নেই আমজনতার। ব্যাংকে টাকা রাখার ক্ষেত্রে আবগারি শুল্ক আগের চেয়ে বাড়িয়েছেন, অর্থাৎ সামান্য সঞ্চয়ের টাকা ব্যাংকে রাখার জো নেই। বিদ্যুৎ বিলেও এবার বাড়তি ভ্যাট গুণতে হবে। ১ জুন থেকে বিদ্যুতের বিল বেড়েছে, সেই সাথে আরও বাড়ার আগাম ঘোষণাও অর্থমন্ত্রী মহোদয় দিয়ে রেখেছেন। প্রস্তাবিত বাজাটে এবং চলমান অর্থনীতির ধারায় প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতার চিত্র আছে। কিন্তু সমতা নেই, নেই স্বস্তি। স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পরেও কাক্সিক্ষত সমতাভিত্তিক সমাজ আসেনি। বরং ধনী-গরিবে, গ্রাম-শহরে অর্থনৈতিক ও জীবনমানের ব্যবধান ক্রমেই বাড়ছে। এই বৈষম্য ঘোচানোর কোনো দিকনির্দেশনা নেই প্রস্তাবিত বাজেটে।আর যে হারে কর বিশেষ করে পরোক্ষ করের (ভ্যাট) বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হলো, তার অভিঘাত বেশি হারে বইতে হবে নি¤œবিত্ত-মধ্যবিত্ত-সাধারণ মানুষকেই। ধনীরা বরং অনেক ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ করের আওতা থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছেন। কারণ করপোরেট কর আগের বছরের তুলনায় এক শতাংশ বাড়েনি, রয়েছে অপরিবর্তিত। ফলে সমতা আনয়নের কথা এখনও আকাশকুসুম চিন্তা। সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষকের জন্য ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা এ বাজাটে নেই। নেই শ্রমিকের জন্য নূন্যতম জাতীয় মজুরি কাঠামোর স্পষ্ট কোনো ইঙ্গিত। কর্মসংস্থানের কার্যকর কোনো পথচিত্র সামনে নেই। কৃষকের ফসলের দাম, শ্রমিকের শ্রমের দাম না দিয়ে, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের যথাযথ সুযোগ সৃষ্টি না করে কেবল উন্নয়ন আর প্রবৃদ্ধির ধারা সাময়িকভাবে এগোতে পারে, তাতে পথচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। উন্নয়নের প্রধান কারিগর যে শ্রমজীবী মানুষ, তারা উন্নয়নের সফলতা থেকে বঞ্চিত থাকেন। তাতে মানুষে মানুষে বৈষম্য বাড়ে। সমতার স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই থেকে যায়। জনমনে অস্বস্তি বাড়ে।

মাননীয় স্পিকার নদ-নদী ও সুন্দরবন বাংলাদেশের প্রাণ। কিন্তু দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসন ও পরিকল্পিতভাবে নদ-নদী খননে কোনো সমন্বিত উদ্যোগ নেই। আমার নির্বচনী এলাকায় কপোতাক্ষ খনন হচ্ছে কিন্তু শালথা ও বেতনা খনন হচ্ছে না। আসন্ন অর্থ বছরের বাজেট থেকে শালথা ও বেতনা নদী পরিকল্পিতভাবে খননের জন্য আমি দাবী করছি। উন্নয়নের মহাসড়কে আমার নির্বাচনী এলাকার জনগণ উঠতে পারছে না Ñ কারণ সড়ক ও জনপদের অধীন কলারোয়া-সরসকাটি, কুমিরা-তালা, যশোর-সাতক্ষীরা সড়কসমূহ চলাচলের অযোগ্য। দ্রুত সংস্কার অতীব জরুরি। আমার নির্বাচনী এলাকার হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতী রয়েছে। সাতক্ষীরা থেকে মংলা সমুদ্র বন্দরের দূরত্ব ৯০ কিমি। এখানে সরকারি উদ্যোগে শ্রমঘন অর্থনৈতিক জোন গড়ে তুলতে পারলে বেকাররা বেকারত্বের কষাঘাত থেকে মুক্তি পাবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে যাতে করে রাজধানীর উপর চাপ কমবে। সাতক্ষীরা জেলায় পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের দাবী দীর্ঘ দিনের। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট দাবি করবÑ সাতক্ষীরায় পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ আগামী নির্বাচনের আগেই নেবেন। নন এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে পাঠ দানের অনুমতি, পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি প্রদান করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কিন্তু বিগত ৭-৮ বছর ঐ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিও ভুক্ত না করার ফলে সরকার বিতর্কিত হচ্ছে। দ্রুত এমপিও ভুক্ত করার দাবী জানাচ্ছি। সেইসাথে শিক্ষাকে জাতীয়করণের দাবী জানাচ্ছি। সাতক্ষীরা শহরকে যানজট  মুক্ত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত বাইপাস সড়কের কার্যক্রম শুরু হয়েছে কিন্তু বাইপাস সড়কটি ভোমরা বন্দরের আলীপুর চেকপোস্ট থেকে শুরু না হয়ে মেডিকেল কলেজের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়ায় জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। নকশাটি সংশোধন করলে ক্ষোভ নিরসন হবে এবং রোগীও বাঁচবে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে যোগাযোগ রক্ষার জন্য প্রয়োজন বাহন, কিন্তু আমার নির্বাচনী এলাকার ৩টি পুলিশ স্টেশনে চলাচলযোগ্য যানবাহন নেই। ৩টি পিকআপ প্রদানের জন্য মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিকট দাবী জানাচ্ছি। চিকিৎসা ক্ষেত্রে সাতক্ষীরা জেলায় নৈরাজ্য বিরাজ করছে। সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজে পূর্ণাঙ্গরূপে চিকিৎসা চালু হয়নি। অপরদিকে সদর হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক না থাকায় সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে। সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজে পূর্ণাঙ্গরূপে চিকিৎসা দ্রুত চালুসহ সকল হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক পোস্টিং দিতে হবে। সেইসাথে কমিউনিটি হাসপাতালে অবকাঠামোগত সংস্কারসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসক পোস্টিং দিতে হবে।