সাতক্ষীরা

কৈখালী স্কুলের প্রধান শিক্ষক আত্মহত্যায় প্ররোচনার আসামীদের ফোনালাপ ফাঁস!

By daily satkhira

January 28, 2023

নিজস্ব প্রতিনিধি: আপনি ভালো হয়ে যান ভাই, আপনি ভালো হয়ে যান। আপনার কিন্তু হিসেব কিতেব অন্য রকম হয়ে যাবে। আপনি সুস্থ হুয়ে যান আপনার হিসেব কিতেব আমি ক্লিয়ার করে দেবান। আপনি এখন অসুস্থ, আপনার এখন কিচ্চু বোলতিচ নে, আপনি সুস্থ্য হলি আপনার ক্লিয়ার করে দেবো আমি.. তাই আপনার কোন বাপ আছে- কোন পীর সাহেব আছে…… ভাই আপনি বাঁচবেন না আল্লার কিরে। আল্লার কিরে আপনি বাঁচবেন না। আপনি মুরে যাবেন। আপনি শোনেন- আপনি যতই কেরামতি খাটান- আপনি নিঃস্ব ফকির হুয়ে যাবেন। মুরে যাবেন আপনি। আপনি আমার বাইরি গিলে আপনি মুরে যাবেন। দ্যাখেন- আমি কিন্তু এখনো বাড়িত্তে বাইরি যাইনি, কৈখালী ছাড়িনি বলো…… আপনি যদি বাঁচতি চান তো, আমাগের লাইনে আসেন। আপনি বাঁচতি পারবেন না। আমার হিসেব করা হয়ে গেছে- আপনি বাঁচতি পারবেন না। আপনি বাঁচতি পারবেন, ভিআইপি মর্যদার উপর থাকবেন, না হলে বাঁচতি পারবেন না। শোনেন আপনার বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা হচ্ছে। মামলা হুয়ে গেছে ঢাকায়। ওই মামলায় দুই/ একদিনের ভিতরে আপনরার ওয়ারেন্ট আসবে। বাস্তব কথা- আমার বুলেচ বুলে আমি আপনার বোলতিচ। এ নিয়ে অনেক হাইকোর্ট -মোট সব জায়গায় এ হচ্ছে। ওর চাইতে আমি বোলতিচ কি আপনি এভাবে না মুরে আপনি আমাগের কথা শোনেন। আপনার সবকিছু সল্ভ হুয়ে যাব্যান। আমাদের- বিশেষ করে আমার – শোনেন- আপনি কাল স্কুলে আইসতেছেন না! আসেন তারপর……

উপরোক্ত কথাগুলো শ্যামনগর উপজেলা কৈখালী শামসুর রহমান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অভিভাবক সদস্য আলী মর্ত্তুজা মোবাইল ফোনে স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবুল বাসার (৫৫) কে তার আত্মহত্যার দু’দিন আগে বলেছিলেন। যা ইতোমধ্যে বিভিন্ন অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ফোনালাপে হুমকির বিষয় স্পষ্ট হওয়ায় জেলার সচেতনমহলসহ স্থানীয়রা আলী মর্তুজা ও চেয়ারম্যান আব্দুর রহিমকে দোষারোপ করে শাস্তির দাবী করেছেন।

তাছাড়া, মৃত্যুর আগে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির আলোচনা সভায় নবনির্বাচিত কমিটির সদস্যদের সামনে এই আলী মর্ত্তুজা প্রধান শিক্ষক আবুল বাশারকে শারিরিকভাবে লাঞ্চিতও করেছিলেন। শুধু তাই নয়, স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগে আলী মর্ত্তুজা- রহিম চেয়ারম্যান গ্রুপের দুশ্চরিত্রা জনৈক মারুফা খাতুনের আবেদন নিয়োগ বোর্ড কর্তৃক বাতিল হলে তাকে দিয়ে প্রধান শিক্ষক আবুল বাশারের বিরুদ্ধে ধর্ষণ চেষ্টার মামলা করিয়ে সৎ ও নিষ্ঠাবান প্রধান শিক্ষকের চরিত্র হনন করা হয়। আবার সেই মামলা উঠিয়ে নেয়া এবং অন্যান্য বাবদ ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবী করা হয়েছিল স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক আব্দুল মজিদকে দিয়ে। অবশ্য ওই ৫০ লাখ টাকার ৫ লাখ টাকা ইতোমধ্যে তিনি (প্রধান শিক্ষক) আত্মসম্মানের কথা চিন্তা করে পরিশোধ করেছিলেন বলে ফোনালাপে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। অথচ, এমন একটি চাঞ্চল্যকর মামলার আসামীরা সকলে জজকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন। জামিনে মুক্ত হয়েই আসামীরা প্রধান শিক্ষক আবুল বাশারের পরিবারকে বিভিন্ন ভাবে হুমকি ধামকি অব্যহত রেখেছে।

এদিকে, প্রধান শিক্ষক আবুল বাশারের আপন ভাগ্নী জামাই আব্দুল মান্নানকে সহকারী প্রধান শিক্ষক না করাতে তিনিও মামা শ্বশুরের বিরুদ্ধে গিয়ে আলী মর্ত্তুজা- রহিম চেয়ারম্যান গ্রুপের সাথে হাত মিলিয়ে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। সময়ে অসময়ে মান-অপমান করে। একপর্যায়ে স্কুলের অন্যান্য শিক্ষকরাও প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। অবশেষে একঘরে হয়ে পড়েন প্রধান শিক্ষক আবুল বাশার। এদিকে গত ১৮/১২/২০২২ ইং তারিখে অপারেশ হওয়ায় ডাক্তারের নির্দেশনা মোতাবেক নতুন কমিটির কাছে শিক্ষক আবুল বাশার এমাসের (২৬/১২/২০২২ থেকে ২৫/০১/২০২৩ ইং) চিকিৎসা ছুটির আবেদন করলেও তা না মঞ্জুর করে উল্টো সভাপতি শেখ আব্দুর রহিম ০২/০১/২০২৩ ইং তারিখে দুই বছর পূর্বে নিয়োগ হওয়া ল্যাব সহকারী, অফিস সহায়ক, নৈশ প্রহরী ও আয়া পদে পূর্ব নির্ধারিত ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগে কারণ দর্শানো নোটিশ প্রদান করে ৭ কর্ম দিবসের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়। মোট কথা, প্রধান শিক্ষক আবুল বাশারের আত্মহত্যার প্ররোচনায় যাদেরকে আসামী করা হয়েছে তারা সকলেই একযোগে কেউ চাঁদার টাকা চেয়ে, কেউ জীবননাশের হুমকি দিয়ে, কেউ অপহরনের ভয় দেখিয়ে, কেউ অপমানমূলক কথা বলে, কেউ চাকরী খেয়ে ফেলানোর ভয় দেখিয়ে, কেউ পূর্বের কমিটির দেয়া নিয়োগের হিসেব চেয়ে তাকে উত্যক্ত করতে থাকে। সর্বশেষ, স্কুলের অভিভাবক সদস্য আলী মর্ত্তুজা তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়ার একদিন পর্ইে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হন। প্রধান শিক্ষক আবুল বাশারের আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে বুধবার (৪জানুয়ারী রাতে) মৃতের স্ত্রী মোছা. নুরুন্নাহার পারভীন বাদী হয়ে শ্যানগর থানায় একটি মামলা করেন।

মামলায় স্কুলের সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম, যাদবপুর গ্রামের শেখ মোমিন আলীর ছেলে কমিটির অভিভাবক সদস্য আলী মোর্তুজা, একই গ্রামের মোস্তফা আলী গাজীর স্ত্রী অভিভাবক সদস্য মারুফা খাতুন, পশ্চিম কৈখালি গ্রামের জমির গাজীর ছেলে অভিভাবক সদস্য জাকির গাজী, সাহেবখালি গ্রামের শেখ নওশের আলীর ছেলে স্কুলের সহকারি প্রধান শিক্ষক মোঃ সালাহউদ্দিন, একই গ্রামের বাহার আলী গাজীর ছেলে সমাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষক আব্দুল মান্নান ও বৈশখালি গ্রামের মতিউল্লাহ সরদারের ছেলে শারীরিক শিক্ষা বিভাগের শিক্ষক আব্দুল মজিদকে আসামী করা হয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান রেজাউল করিম স্কুলের সভাপতি থাকাকালীন ২০২১ সালে অফিস সহায়ক, আয়া, নৈশপ্রহরী ও ল্যাব সহকারি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেন প্রধান শিক্ষক আবুল বাশার। আবেদন বিধি মোতাবেক না হওয়ায় আয়া পদে জনৈক মারুফা খাতুনের আবেদনপত্র বাতিল করেন নিয়োগ বোর্ড। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বর্ণিত আসামীদের সহযোগীতায় মারুফা খাতুন প্রধান শিক্ষক আবুল বাশারের নামে মিথ্যা ধর্ষণের চেষ্টা ও টাকা আত্মসাতের মামলা দায়ের করেন। জামায়াত নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম স্কুলের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর প্রধান শিক্ষক আবুল বাশারকে হয়রানি করা শুরু করেন। এ দিকে, বিরোধ মিটিয়ে দেওয়ার কথা বলে শিক্ষক আব্দুল মজিদ, সহকারি শিক্ষক সালাহউদ্দিন, শিক্ষক আব্দুল মান্নান, অভিভাবক সদস্য মারুফা খাতুন ও জাকির হোসেনের যোগসাজসে বর্তমান সভাপতি আব্দুর রহিম ও অভিভাবক সদস্য আলী মোর্তুজা প্রধান শিক্ষকের কাছে ৫০ লাখ টাকা দাবি করেন। প্রধান শিক্ষক তাদেরকে সম্প্রতি পাঁচ লাখ টাকাও দেন। বাকী ৪৫ লাখ টাকার জন্য আলী মোর্তুজাসহ অন্যান্যরা প্রধান শিক্ষককে চাপসৃষ্টি ও মেরে ফেলার হুমকি অব্যাহত রাখায় তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কেএম রেজাউল করিম শনিবার (২৮ জানুয়ারি) জানান, দায়েরকৃত মামলায় ইতোমধ্যে ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। তবে অন্য আসামী মারুফা খাতুন মোবাইল ফোন ব্যবহার না করায় তার অবস্থান নির্নয় করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

প্রধান শিক্ষক আত্মহত্যার পরোচনার বিষয়ে স্কুলের একাধিক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রধান শিক্ষক খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছে। হেড স্যারের মত চরিত্রবান একজন মানুষকে আত্মহত্যায় বাধ্য করায় নবনির্বাচিত ম্যানেজিং কমিটিই দায়ী। বিশেষ করে আলী মর্তুজা ও মারুফা খাতুন সবচেয়ে বেশী দায়ী। আমরা দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।