জাতীয়

সহসাই কমছে না চালের দাম

By Daily Satkhira

June 16, 2017

অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে চালের দাম। এর ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। সহসাই কমছে না বেড়ে যাওয়া চালের দাম। আর এই দাম কমানোর বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সন্তোষজনক কোনও উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ২০০৭ ও ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মোটা চালের কেজি ৪০ টাকা এবং সরু চালের কেজি ৫৬ টাকায় উঠেছিল। নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জসহ দেশের ছয় জেলায় বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে হাওরের ধান নষ্ট হয়ে যাওয়ার ইস্যুকে পুঁজি করে বাড়তে থাকে চালের দাম। এরপর থেকে আর স্থিতিশীল হয়নি চালের বাজার। এখন বাজারে ৫০ টাকার নিচে কোনও মোটা চাল নেই। ৬৫ টাকার নিচে পাওয়া যায় না ভালো মানের চিকন চাল। হাওরে বন্যায় ডুবে যাওয়া ১০ লাখ মেট্রিক টন চালের ঘাটতি মেটাতে ওই সময় বিভিন্ন মহল থেকে বারবার চাল আমদানির দাবি উঠেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার জরুরি ভিত্তিতে ৬ লাখ টন চাল সরকারিভাবে আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। পরে আরও ৪ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই চাল এলেই বাজার স্বাভাবিক হবে। তবে এখনও সরকারিভাবে আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া চালের এক কেজিও দেশে এসে পৌঁছেনি। কবে নাগাদ ওই চাল দেশে আসতে পারে, সেই প্রশ্নেরও কোনও জবাব দিতে পারছেন না সরকারের দায়িত্বশীল কেউ। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকার টু সরকার পদ্ধতিতে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়াগত জটিলতায় আটকে আছে। এরই মধ্যে বুধবার (১৪ জুন) আবার আড়াই লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা হবে এ চাল। এর মধ্যে ৫০ হাজার টন সিদ্ধ ও দুই লাখ টন আতপ চাল। টনপ্রতি চলের দাম পড়বে ৪৭০ মার্কিন ডলার। ৮০ টাকায় ডলার হিসাবে এই চালের দাম পড়বে প্রতিকেজি ৩৭ টকা ৬০ পয়সা। তবে এই আড়াই লাখ টন চালও কবে নাগাদ দেশে আসতে পারে, সে সম্পর্কে কোনও তথ্য জানাতে পারেননি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বা বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। অনেকেই বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে যোগাযোগ করেও নাকি চাল পাওয়া যায়নি। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, চালের দাম বেশি বেড়েছে গত পাঁচ মাসে। প্রতিমাসেই সব ধরনের চালের দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা করে। প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও বাড়ছে মোটাসহ সব ধরনের চালের দাম। এই সময়ে চিকন চালের দামও বেড়েছে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা। এখন বাজারে ৫০ টাকার নিচে কোনও মোটা চাল নেই, ভালো চিকন চালও নেই ৬৫ টাকার নিচে। তবে চালের দাম বাড়ার কারণ জানেন না কেউ। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিলারদের কারসাজিতে বেড়েছে মোটা চালের দাম। সেই দাম এরই মধ্যে স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ১৫ টাকা কেজি দরে খোলা বাজারে চাল বিক্রি করলেও তা বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারছে না। রাজধানীর কোথায় এই চাল বিক্রি করা হয়, তা খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। এদিকে, কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে এখনও বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির অনুমতি দিচ্ছে না সরকার। তবে পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে গেলে যেকোনও সময় বেসরকারিভাবেও চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে। সরকারের একটি সূত্র জানায়, গত কয়েক বছরে কৃষক উৎপাদিত ধানের দাম নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল না। এ বছর চালের দাম বাড়তে থাকলে কৃষকের কথা চিন্তা করেই বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির বিষয়টি নিয়ে ভাবেনি সরকার। কারণ, ২০১৪ সালে বেসরকারিভাবে বিপুল পরিমাণে চাল আমদানি হওয়ায় দেশের বাজারে চালের দাম একেবারেই কমে যায়। ফলে ওই বছর ধানের ন্যায্যমূল্য পাননি কৃষকরা। তাদের অনেকে ধান উৎপাদনে আগ্রহও হারান। চালের বাজারের অস্থিরতা প্রসঙ্গে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে চালের দাম। সরকার স্বীকারই করতে চায় না যে চালের দাম ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে গেছে। হাওরাঞ্চলের সাত জেলায় এ বছর আগাম বন্যায় ব্যাপক ফসলহানি হয়েছে। আরও ১৯টি জেলায় ধানক্ষেতে ছত্রাকের আক্রমণে (ব্লাস্ট রোগ) উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই দুই কারণে এ বছর ১০ লাখ টনের বেশি বোরো ধান নষ্ট হয়েছে।’ ট্রেডিং করপোরেশন অব বংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের এই সময় উন্নতমানের মিনিকেট ও নাজিরশাইল চালের কেজি ছিল গড়ে ৪৮ থেকে ৫২ টাকা। আর এখন বাজারে সাধারণ মানের মিনিকেট চালের কেজিই ৫৬-৬০ টাকা। যদিও সাধারণ মানের মিনিকেট চালের দাম গত বছরের এই সময়ে ছিল ৪৪ থেকে ৪৮ টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ বেশি খায় বিআর-২৮ ও পাইজাম চাল। এই দুই প্রকারের চালের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। বাজারে এখন বিআর-২৮ চালের কেজি ৫২ থেকে ৫৬ টাকা, পাইজাম চালের কেজি ৫০ থেকে ৫৪ টাকা। অথচ জানুয়ারিতেও এসব চালের দাম ছিল প্রতিকেজি ৪৬ থেকে ৪৮ টাকা। আর গত বছরের এই সময়ে দাম ছিল ৪০ থেকে ৪২ টাকা। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে এসব চালের দাম বেড়েছে ১৯ দশমিক ৫১ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা জানান, চালের দামকে কেন্দ্র করে অন্য সব নিত্যপণ্যের দামও বেড়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়তে হচ্ছে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষকে। তারা হিমশিম খাচ্ছেন সংসার চালাতে। বিপাকে পড়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণিও, তবে লোকলজ্জার ভয়ে তারা এ বিষয়ে উচ্চকিত হতে পারছেন না। ঢাকায় দিনাজপুর থেকে আসা দিনমজুর মজনু মিয়া কাজ করেন কাওরান বাজারের কিচেন মার্কেটে। বিভিন্ন পাইকারি দোকানের পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজ করেন তিনি। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে দিন শেষে চারশ টাকা পেলেই বাজার খরচ কিনে বাসায় যেতাম। এখন পারি না। চাল কিনতেই বাড়তি খরচ ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। এর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে মাছ, মাংস ও সবজি, হলুদ, মরিচ, পেঁয়াজ—সবকিছুর দামই বেড়েছে। তাই চারশ টাকার বাজার করতে এখন লাগে পাঁচশ থেকে সাড়ে পাঁচশ টাকা। কিন্তু বাড়তি সেই টাকা কোথায় পাবো?’ আক্ষেপের সুরে মজনু মিয়া বলেন, ‘আমার আয় তো বাড়েনি!’