কালিগঞ্জ

২০ নভেম্বর কালিগঞ্জ হানাদার মুক্ত দিবস

By daily satkhira

November 19, 2023

আহম্মাদ উল্যাহ বাচ্ছু॥ ২০ নভেম্বর ঐতিহাসিক কালিগঞ্জ মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের সম্মুখ যুদ্ধে কালিগঞ্জ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়। আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য সাহস ও মনোবলের কারণে পাকিস্তানী সেনারা পরাজয় স্বীকার করে কালিগঞ্জ ছেড়ে চলে যায়। দীর্ঘ আট মাস যুদ্ধ শেষে অবরুদ্ধ কালিগঞ্জ বাসি এই দিন মুক্তির আনন্দে মেতে উঠে। কালিগঞ্জ অঞ্চলের যুদ্ধে মুক্তি সেনারা যত না হতাহত না হয়, হানাদার বাহিনীর সৈনিকেরা তার চেয়ে অনেক বেশী হতাহত হয়। এটাই কালিগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের গৌরব। মুলত স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছিল বাঙ্গালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পরপরই। কালিগঞ্জ ছিল বরাবরই একটা শান্ত জনপদ। এখানকার মানুষও ছিল শান্তি প্রিয়। কিন্ত সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের জয় এবং বঙ্গবন্ধুকে সরকার গঠনের সুযোগ না দেওয়ায় কালিগঞ্জবাসি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তারা পাকিস্তানীদের এই অন্যায়ের প্রতিবাদে প্রতিদিন মিটিং মিছিল করতে থাকে। ৭ মার্চ থেকে সেই প্রতিবাদ আরো জোরালো ও জঙ্গী রুপ ধারণ করে। সারা কালিগঞ্জ মিছিলে মিছিলে, শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। বিশেষত ছাত্র-শিক্ষক ও তরুণেরা আওয়ামীলীগ ও সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের প্রেরণার উৎস হিসোবে শক্তি যোগাতে থাকে। ক্রমে সাধারণ মানুষও এই আনন্দোলনে যোগ দেয়। চলে লাঠি মিছিল, মশাল মিছিল, পতাকা মিছিল। দেখতে দেখতে কালিগঞ্জ যুদ্ধের উম্মাদনায় অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। এ সময় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রতিটি থানায় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের দিন রাত শ্লোগনে, বক্তিৃতায় কালিগঞ্জকে যুদ্ধংদেহী করে তোলে। ৮ মার্চ কালিগঞ্জের ডাকবাংলা চত্বরে শত শত মানুষ সমবেত হয়ে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে উন্মত্ত আক্রোশে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে ফেলে। এরপর শুরু হয় জঙ্গী মিছিল। এসময় হাজার হাজার মানুষের পদভারে কালিগঞ্জের মাটিতে শুরু হয় ভূমিকম্প। ঐদিন নেতারা সিদ্ধান্ত নেয় পাক আর্মিরা কোন ভাবে যেন সাতক্ষীরা পার হয়ে কালিগঞ্জে ঢুকতে না পারে। ১০ ও ১১ এপ্রিলের দিকে রটে যায় পাকিস্তানী আর্মি কালিগঞ্জের দিকে আসছে। এখবর শুনে ক্রোধে ও উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা। দ্রুত এলাকার সমস্ত বন্দুকধারীদের সংঘবন্ধ করে কালিগঞ্জ বাজার থেকে থানা পর্যন্ত নদীর তীরে গেওয়া বাগানের ঝোঁপের মধ্যে পজিসন নেয় বন্দুকধারীরা। হঠাৎ রটে গেল সংগ্রাম পরিষদের একটা নামের লিস্ট আর্মিদের কাছে পৌছে গেছে। সেই মোতাবেক জন্মভূমি ত্যাগ করে ১৪ এপ্রিল থেকে ২০ এপ্রিলের মধ্যে সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্য সীমান্তের ইছামতি ও কালিন্দী নদী পার হয়ে ভারতের হিঙ্গলগঞ্জ চলে যায়। এদিকে সকল বাধা বিপত্তি ও মায়া-মমতা কাটিয়ে মে মাসের মধ্যে শত শত দামাল ছেলেরা দেশমুক্তির শপথ নিয়ে মুক্তিযদ্ধে যোগ দেয়। অপর দিকে পাকিস্তানী আমির্রা ঘাঁটি গাড়ে কালিগঞ্জের ওয়াপদা ডাক-বাংলা ভবন, বসন্তপুর চন্দ্রদের পরিত্যাক্ত বাড়ি, হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকা, দমদম ফেরি ঘাটের বরফকল এবং খানজিয়া ই.পি.আর ক্যাম্পে। পাক বাহিনী দ্রুত তাদের পরিধি আরো সম্প্রসারিত করে সাদপুর ব্রীজ, ভাড়াশিমলার কাশেম আলীর বাড়ি, গফ্ফার চেয়ারম্যানের বাড়ি, নাজিমগঞ্জ করিম গাইনের বাড়ি, শুইলপুর আক্কাজ গাজীর বাড়ি, খানজিয়া, বসন্তপুর, উকসা ও পিরোজপুরসহ গোটা সীমান্ত এলাকা ঘিরে ফেলে। এবং নিরিহ নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের উপর নানা রকমের অত্যাচার শুরু করে। এসময় তারা সারা দেশের ন্যায় কালিগঞ্জেও গঠণ করে পিস কমিটি ও রাজাকার বাহিনী। এদিকে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিশোধ স্পৃহায় দ্রুত আর্মস ট্রেনিং নেওয়ার জন্য ভারতের হিঙ্গলগঞ্জসহ বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্পে চলে যায়। মে মাসের মধ্যে ট্রেনিং শেষে সীমান্ত পেরিয়ে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ৯নং সেক্টরের অধিনায়ক মেজর জলিল ও তার সহযোগী ক্যাপ্টেন নূরুল হুদা, লে. মাহফুজ আনাম বেগ, লে. আরেফিন, লে. শচীন কর্মকার ও মেজর লিয়াকতের নেতৃত্বে জুন থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন সময় নিজ মাতৃভূমির উপর কৌশলে হায়না বাহিনীর সদস্যদের উপর একাধিক বার চোরা গুপ্তা আক্রমণ চালায়। এসময় পাকিস্তানী সেনারা কালিগঞ্জ দখলে রাখতে বিভিন্ন ক্যাম্পে ভারী অস্ত্রশস্ত্র মেশিনগ্যান, কামান, মর্টার ইত্যাদি মজুদ করতে থাকে। এবং মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ খবর পেতে তারা গোয়েন্দাও নিয়োগ করে। তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রের বিরুদ্ধে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা সাধারণ মানের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মনের সাহস নিয়ে অসম যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধরা প্রথমে বসন্তপুর বিওপি, খানজিয়া ক্যাম্প ও থানা সদরের বিওপি ক্যাম্পের উপর আক্রমণ শুর করে। পরে বাগবাটি, পিরোজপুর, ভাড়াশিমলা, রতনপুর, নজিমগঞ্জ, উকসা দুদলীসহ বিভিন্ন পাক সৈন্যদের ঘাঁটিতে বারবার সশস্ত্র আক্রমণ করে পাক বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ফেলে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে অক্টোবর ও নভেম্বরে গোটা কালিগঞ্জ একটা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ আর রাইফেল, মেশিনগান, গ্রেনেড, রকেট লাঞ্চারের শব্দে ও আগুনে কালিগঞ্জের আকাশ, বাতাস, মাটি, প্রকম্পিত হতে থাকে। উকসা, পিরোজপুর, খানজিয়া ও বসন্তপুর পাকিস্তানী ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধোদের সাথে অন্যতম সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে কালিগঞ্জের আপামর সাধারণ মানুষ পাকিস্তানী নরপশুদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। সে সময় সকল স্তরের জনতা সাহায্যের হাত বাড়ালে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধটা আরো সহজ হয়ে যায়। ১৯ নভেম্বর মাহফুজ আলম লে. বেগ এর নেতৃত্বে শ্যামনগর শত্রুমুক্ত হওয়ার পরপরই তারা কালিগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধদের সাথে মিলিত হয়ে ২০ নভেম্বর কালিগঞ্জ পাক সেনাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। এই যুদ্ধে পাক সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের মোকাবেলা করতে না পেরে ঐদিন ভোরে কালিগঞ্জ ছেড়ে পালিয়ে দেবহাটা অভিমুখে চলে যায়। এ খবরে উল্লোসিত হয়ে ডাকবাংলা চত্বরে মুক্তিযোদ্ধারা সমবেত হয়। ফুটতে থাকে শত শত গুলি। জয় বাংলার শ্লোগানে কম্পিত হয় কালিগঞ্জ। ৯ নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কামন্ডার ক্যাপ্টেন নূরুল হুদা মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার সমন্বয়ে দুপুরে প্রথমে ওয়াপদার ডাকবাংলো এবং পরে অনুষ্ঠানিক ভাবে ডাকবাংলা চত্ত্বরে লাল সবুজের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্যে দিয়ে কালিগঞ্জে স্বাধীনতার শুভ সুচনা হয়। ২০ নভেম্বর ছিল ঈদুল ফিতরের দিন। স্বাধীনতার আনন্দ ঈদের আনন্দে পরিনত হয়।