১৯৮০ সালের মে মাস। চীন সরকার শেনঝেন নগরীকে এক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বলে ঘোষণা করলো। ইয়ং ইয়া এখনো মনে করতে পারেন সেসময়ের শেনঝেন। মাত্র চার বছর বয়সে তিনি সেখানে এসেছিলেন।
“শেনঝেন তখন একটা বিরাট গ্রামের মতো। সেখানে কিছু কারখানাও ছিল। তবে মনে হচ্ছিল সেখানে সারাক্ষণই নতুন বাড়ি তৈরির কাজ চলছে।”
১৯৮৪ সালে ইয়াং ইয়া-র মা যে কারখানায় কাজ করতেন, সেটা শেনঝেনে সরিয়ে নেয়া হলো। ফলে তাদেরও সেখানে চলে যেতে হলো।
চীনের উপকুল বরাবর চারটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছিল। চীন সরকার তাদের অর্থনীতি নিয়ে এক নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছিল। এটি ছিল তারই অংশ।
তাদের লক্ষ্য সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পিত অর্থনীতি থেকে বাজার অর্থনীতির দিকে যাওয়া। আরও সহজ করে বললে, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যেই তারা পুঁজিবাদী অর্থনীতি চালু করতে চাইছিল।
মেরি অ্যান ও ডনেল একজন শিল্পী এবং এথনোগ্রাফার। তিনি শেনঝেনে আছেন ১৯৯৫ সাল থেকে। কিভাবে একটা কর্দমাক্ত গ্রাম থেকে শেনঝেন হয়ে উঠলো বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মেগাসিটি, তার শেষ পর্বটা তিনি নিজের চোখে দেখেছেন।
“আশির দশকে শেনঝেনে লোকজন আসতে এই কারণে নয় যে এটি দারুণ আকর্ষণীয় কোন জায়গা ছিল। শেনঝেনে তখনো নির্মাণযজ্ঞ চলছে। কাদামাখা একটা জায়গা। বিদ্যুত আসে যায়। বর্ষা মওসুমে শেনঝেন বন্যায় ভেসে যায়। সেখানে পানি-নিস্কাশন ব্যবস্থা মোটেই ভালো নয়। কাজেই লোকজন এখানে এ কারণে আসতো না যে এটা একটা দারুণ নগরী। লোকজন এখানে আসতো কিছু একটা শুরু করার ইচ্ছে নিয়ে।”
বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণার আগে শেনঝেন ছিল মূলত কৃষিপ্রধান এলাকা। শেনঝেন প্রসিদ্ধ ছিল শুকর, শামুক আর লিচুর জন্য। কিন্তু জায়গাটি ছিল ব্রিটিশ কলোনি হংকং এর খুবই কাছে।
১৯৬০ এবং ৭০ এর দশকে হংকং এক বিরাট অর্থনৈতিক কেন্দ্র হয়ে উঠে এর গভীর সমূদ্র বন্দরের কারণে। কমিউনিষ্ট চীন আর বাকী বিশ্বের মাঝখানে হংকং ছিল এক সুবিধেজনক জায়গায়। চীনের সঙ্গে হংকং সীমান্তে কড়াকড়িও ছিল কম। এই সুযোগে শেনঝেনে যেসব পণ্য তৈরি হতো, সেটি বাইরে বিক্রির জন্য হংকং হয়ে উঠলো এক সুবিধেজনক জায়গা।
মেরি অ্যান ও ডনেল বলছিলেন, “শুরুতে তাদের আইডিয়াটা ছিল দোকান থাকবে সামনে, আর কারখানা পেছনে। অর্থাৎ শেনঝেনে স্থাপিত হবে কারখানা, কারণ এখানে উৎপাদন খরচ কম পড়বে। এরপর এখান থেকে পণ্য নিয়ে যাওয়া হবে হংকং এ। সেখানকার বন্দর থেকে চীনা পণ্য যাবে বাকী বিশ্বে।”
কী ধরণের পণ্য তখন শেনঝেনে উৎপাদিত হচ্ছিল?
“এটা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। তখন আসলে তারা সব কিছুই করছিল। ধরুণ ১৯৯০ এর দশকের শুরুতে আপনি সনি ওয়াকম্যানে গান শুনছেন। সেটি তৈরি হয়েছে শেনঝেনে। আপনি একটি বুমবক্স কিনেছেন। সেটি শেনেঝনে তৈরি। নিকন্যাক্স, সস্তা সাবান, বলতে পারেন্ তখন সবকিছুই শেনঝেনে তৈরি হচ্ছে।”
ইয়ং ইয়া যখন শেনঝেনে এসে পৌঁছান তখন তাঁর মা ইলেকট্রনিক শিল্পে একজন প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেন। মা মেয়ে তখন থাকেন এক ডরমিটরিতে।
” কোম্পানি থেকেই আমাদের সেখানে থাকতে দেয়া হয়েছিল। সেখানে আরও দুই মহিলা থাকতেন। আমাদের থাকতে হতো একটি রুমে। কিন্তু তখন আমাদের কারই সেরকম ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ছিল না। কাজেই আমাদের সেরকম অসুবিধা হয়নি। আমরা আমাদের জিনিসপত্র রাখতাম খাটের নীচে।”
শেনঝেনে তখন চীনের সব জায়গা থেকে লোকজন আসছে কাজ করতে। ইয়াং ইয়ার পরিবার এসেছিলেন চীনের মধ্যাঞ্চলীয় প্রদেশ জিয়াং থেকে।
“আমার শিক্ষক এবং সহপাঠী যারা ছিলেন, তারা এসেছিলেন চীনের নানান জায়গা থেকে। কাজেই তাদের সবার আঞ্চলিক ভাষা আর উচ্চারণ ছিল ভিন্ন। এমনকি শিক্ষকরা পর্যন্ত। আশি থেকে নব্বুই শতাংশ মানুষ কথা বলতো ক্যান্টনিজ ভাষায়। আমার কাছে সেটাকে একটা বিদেশি ভাষা বলে মনে হতো। কাজেই আমাকে ভাষাটা খুব দ্রুত রপ্ত করতে হয়েছিল।”
যে গতিতে তখন শেনঝেন বাড়ছে, তা মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতো।
“আমি দেখতে পাচ্ছিলাম যে শহরটা খুব দ্রুত বড় হচ্ছে। একটা জায়গাকে আপনি যেসব দালান কাঠা দিয়ে চেনেন, সেটা কিন্তু আমি শেনঝেনে যাওয়ার প্রথম দশ বছরে মধ্যে কয়েক মাস পরপরই বদলে যাচ্ছিল। কারণ তখন সেখানে সারাক্ষণই নতুন নতুন ভবন তৈরি হচ্ছিল।”
১৯৮৬ সালে যখন প্রথম শেনঝেনের মাস্টারপ্ল্যান বা মহাপরিকল্পনা তৈরি করা হয়, তখন অনুমান করা হয়েছিল যে সেখানে দু হাজার সাল নাগাদ জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে দশ লাখে। কিন্তু বাস্তবে যা ঘটলো, দুহাজার সাল নাগাদ শেনঝেনের জনসংখ্যা গিয়ে দাঁড়ালো সম্ভবত এক কোটিতে।
জনসংখ্যা যেভাবে হুহু করে বাড়ছিল, তার সঙ্গে শেনঝেনের অবকাঠামো তাল রাখতে পারছিল না। শেনঝেন যেহেতু খুব দ্রুত বাড়ছিল, দ্রুত বদলাচ্ছিল, তাই সেখানে সম্ভাবনাও ছিল বিপুল। শেনঝেন যেন সবাইকে হাতছানি দিচ্ছিল।
শেনঝেন মানুষকে যে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এনে দিল, তার সঙ্গে তারা যেন ব্যক্তিগত জীবনেও অনেক স্বাধীনতা ভোগ করার সুযোগ পেল।
মেরি অ্যান ও ডনেল বলছিলেন, “সেখানে সেক্স ট্যুরিজম শুরু হলো, পতিতাবৃত্তি শুরু হলো। কিন্তু সেখানে নারী-পুরুষের ডেটিং এ যাওয়ারও সুযোগ তৈরি হলো। মাও জেদং এর যুগে নারী-পুরুষকে কঠোরভাবে আলাদা করে দেয়া হয়েছিল, প্রেমকে একটি বুর্জোয়া ধারণা বলে সমালোচনা করা হয়েছিল। কিন্তু শেনঝেন যেন একেবারেই আলাদা। এখানে আপনি যেন সবধরণের সম্পর্ক নিয়ে ভাবতে পারেন। যেটা কিনা পাঁচ বছর আগেও হয়তো ভাবা যেত না।”
কিন্তু যেভাবে শেনঝেন গড়ে উঠছিল, সেটা যে সবাই পছন্দ করছিল তা নয়।
যারা চাইছিল মার্কসবাদী আদর্শের ভিত্তিতে চীনের রাজনৈতিক অর্থনীতির ভিত্তি রচিত হোক, তাদের কাছে মনে হচ্ছিল শেনঝেনের এই পরীক্ষা একটা বেশি তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু লোকজন কিন্তু শেনঝেনকে পছন্দ করছিল ঠিক একারণেই।
ইয়ং ইয়া এখন একজন সঙ্গীত শিল্পী। তিনি বলছিলেন, শেনঝেন ছিল যেহেতু একেবারে নতুন, এবং এটি সবসময় বদলাচ্ছিল, কাজেই এখানে কারও কোন স্থানীয় পরিচয় তৈরি হচ্ছিল না, যেটা অন্য কোন শহরে বেড়ে উঠলে হয়।
“একটা শহরের যে কোন চরিত্র নেই, সেটাকে একটা র্দুবলতা বলেই আপনার মনে হবে। কিন্তু শেনঝেনের এই দুর্বলতাই হয়তো তার শক্তি। যখন কোন শহরের বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্য থাকে না, তখন সেটার জন্য আপনার কোন দায়িত্ববোধও থাকে না। আমি বলবো শেনঝেন একটা মুক্ত শহর, স্বাধীন শহর।”
সূত্র : বিবিসি বাংলা