বাম হাতের দুই আঙ্গুলের মাঝে ধোঁয়া ছড়াচ্ছে সিগারেট। মাঝে মাঝে উঠছে দুই ঠোঁটে। আর ডান হাতের তিন আঙ্গুলের মাথায় কলম। সামনে নিউজ প্রিন্ট কাগজের প্যাড। কাছেই চায়ের কাপ ছেড়ে উড়ছে মিষ্টি ধোঁয়া। এক সাথেই চলছে তিনটি কাজ। মাঝে মাঝে সুখটান দিয়ে শেষের অংশ ফেলে দিয়ে আরেকটি সিগারেটে অগ্নিসংযোগ। চা ফুরালে ‘এই চা নিয়ে আয়। সিগারেট দে’। হঠাৎ সব কিছু ছেড়ে একটু গল্প। একটু আয়েশ। একটু হাসি। ফের লেখায় মনোনিবেশ। যারা সংবাদপত্রে কাজ করেন তারা এমন দৃশ্যের সাথে বহুল পরিচিত। তবে এখন এ দৃশ্যের পরিবর্তন ঘটেছে। এখন সাংবাদিকরা ল্যাপটপ নিয়ে ক্লিক করে তাবত সংবাদ বের করে আনেন। আর না হয় ঠক ঠক করে ডিজিট টিপে টিপে আয়েশে সংবাদ বানিয়ে দেন। কিন্তু কচি ভাইদের মতো নিবেদিত সাংবাদিক এভাবেই বছরের পর বছর কাজ করে গেছেন। আর এভাবেই হয়ে উঠেছেন প্রাতঃস্মরণীয়। আজ এ প্রসঙ্গ এসেছে আমাদের কচি ভাই, মুফতি আবদুর রহিম কচির মৃত্যুর খবরের পর। শুক্রবার বিকাল তিনটায় বাসায় ফিরতেই দুঃসংবাদটি কানে এলো। ক’দিন ধরে ভাবছিলাম। তাকে দেখতে যাবো তার বাসায়। হয়ে ওঠেনি। আজ তার চিরপ্রস্থানে ছেদটা পড়েই গেলো। কচি ভাইয়ের সাথে আমার দেখা হতো সাতক্ষীরার জাহান প্রিন্টিং প্রেসে। প্রয়াত নির্মলদা বসতেন সেখানে। কচি ভাই তার পত্রিকা দখিনায়নের ম্যাটার প্রস্তুত করে এনেছেন। চার পৃষ্ঠার দখিনায়ন। চারটি প্লেট হাতে নিয়ে রিকসায় আসতেন সুলতানপুর থেকে। এরপর ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দখিনায়ন প্রকাশ করে নিয়ে যেতেন। নিজ হাতে কোনো কোনো সময় তরতাজা কাগজ বিলিও করতেন। পাঠিয়ে দিতেন পোস্ট অফিস মোড়ে মেসার্স আরিফ খানের সংবাদপত্র পরিবেশকের দোকানে কিংবা বাস টার্মিনালে। এর আগে সীসার অক্ষর সাজিয়ে পত্রিকার ম্যাটার তৈরি করতেন সুলতানপুর বাজারের মধ্যে এক কোনায় একটি বাসায় বসে। ১৯৭৮ সালে তিনি যখন সাপ্তাহিক দখিনায়ন প্রকাশ করেন তখন সাতক্ষীরার আরেকটি সাপ্তাহিক ছিল, মোতালেব ভাইয়ের কাফেলা। এই কাফেলা পরবর্তীতে আবদুল মোতালেব দৈনিক কাফেলায় উন্নীত করেন। কিন্তু মুফতি আবদুর রহিম কচি তার দখিনায়নকে আর কোনোদিন দৈনিকে তুলতে পারেন নি। আর্থিক টানাপড়েনে পত্রিকাটির অকালমৃত্যু আমরা চেয়ে চেয়ে দেখছি কেবল। কথা ছিল এই মৃত্যুকে সবাই মিলে ঠেকানো হবে। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। কচি ভাই নিজে ছিলেন দখিনায়নের সম্পাদক। নিজেই সাংবাদিক। আবার নিজেই কম্পোজিটর। এতে তিনি অপমান বোধ করেন নি। জেলার বিভিন্ন স্থানে তার প্রতিনিধি থাকলেও কাগজটির অনিয়মানুবর্তিতার কারণে তারাও ঢিল দিতেন। তবে দখিনায়নের পরিচয় দিতে অনেক সাংবাদিকই ভালবাসতেন, সাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। সাতক্ষীরার বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের সাংবাদিকতায় হাতে খড়ি হয়েছে এই দখিনায়নে। কম কথা নয়। কচি ভাই জড়িত ছিলেন কবি পল্টু বাসার সম্পাদিত ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা ঈক্ষণের সাথেও। তারা দুজনেই এক সাথে জাহান প্রেস থেকে পত্রিকা দুটি বের করতেন। তখন সংবাদপত্র সংখ্যায় ছিল কম। এজন্য দখিনায়নের প্রভাবও ছিল বেশ। কোনো রিপোর্ট ছাপা হলে তা নিয়ে বেশ ঝড় উঠতো। আমরাও উপভোগ করতাম। আশির দশকে সাতক্ষীরার বাজারে দখিনায়নের দাপট ছিল তুঙ্গে। সে সময় সওগাত সম্পাদক মো. নাসিরউদ্দিনের কাছ থেকে কবি পল্টু বাসারের নেওয়া সাহিত্যিক মো. ওয়াজেদ আলির ওপর একটি পুর্ণ পৃষ্ঠা সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল দখিনায়নে। সমসাময়িককালে কালিগঞ্জ কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি লতিফুর রহমান বাবলুকে একদিন জেল ভোগ করতে হয়েছিল তৎকালিন নির্বাহী অফিসার হাতেম আলি খানকে ‘স্যার’ না বলে ভাই বলার কারণে। এই রিপোর্ট সাহসের সাথে প্রকাশ করেছিল সাপ্তাহিক দখিনায়ন। স্মৃতিতে হাতড়ালে এমন অনেক তথ্যই পাওয়া যাবে হয়তো। সাতক্ষীরার একটি দৈনিক দাঁড় করাতে যারা শ্রম দিয়েছিলেন তাদেরই একজন এই মুফতি আবদুর রহিম কচি। তিনি সকাল সন্ধ্যা কাজ করে পত্রিকাটিকে পাঠকের কাছে পাঠযোগ্য করে তুলেছিলেন। তিনি নিজে লিখেছেন। তিনি লিখিয়েছেন নবীনদের। মুফতি আবদুর রহিম কচি কেবল একজন নিবেদিত সংবাদকর্মীই ছিলেন না। তিনি ছিলেন ভালো একজন আবৃত্তিকার, একজন অভিনেতাও। জন্ম দিয়েছিলেন সপ্তর্ষি থিয়েটারের, কবিতাকুঞ্জের ও সকাল নাট্যগোষ্ঠীর। নাটক লিখতেন। কবিতা লিখতেন। গান রচনা করতেন। এসব কারণে বারবার পুরস্কৃতও হয়েছেন তিনি। ভারত ও বাংলাদেশের কবি সম্মিলনে যোগ দিতেন তিনি। নিয়মিত কবিতার আড্ডায় সাহিত্যের মজলিশে বসতেন তিনি। কিছুদিন আগে কবি পল্টু বাসারের পৃষ্ঠপোষকতায় সাতক্ষীরায় অনুষ্ঠিত হয় লিটল ম্যগাজিন অনুষ্ঠান। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মুফতি আবদুর রহিম কচি। আমি আমার বক্তব্যে বলেছিলাম ‘দখিনায়নের পুনরুজ্জীবন দেখতে চাই’। কচি ভাই মৃদু হেসে সম্মতি দিয়েছিলেন। সেই কথা তিনি আর রাখেন নি। তার আগেই চলে গেলেন তিনি। মুফতি আবদুর রহিম কচির নিত্য সঙ্গী ছিল দারিদ্র্য। পরিবারের ভরনপোষন ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া কিভাবে চলবে তার কোনো নিশ্চয়তা তিনি কখনও দিতে পারেন নি। নিজের অসুখ বিসুখে ওষুধ কিনতে পারেন নি। শারীরিক সুস্থতার জন্য ভালো খাবারও জোটেনি তার। এর মধ্যে একটি পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ করা কত যে কঠিন তা সহজেই অনুমেয়। কাজকে সম্মান দিতেন তিনি। পরিশ্রমকে ভালবাসতেন তিনি। জীবিকা নির্বাহের জন্য তিনি মাছের খামারে কাজ করেছেন। পানের মসলা তৈরি করে বিক্রি করেছেন। বই বাঁধাইয়ের কাজ করে অর্থ উপার্জন করেছেন। বাড়িতে নিভৃতে বসে কাগজের ঠোঙ্গা বানিয়েছেন তিনি। তবু সংসারের ঘানি টানতে টানতে ক্লান্ত ঘর্মাক্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। কিন্তু সততার মতো গুণ থেকে এতোটুক বিচ্যুত হন নি মুফতি আবদুর রহিম কচি। একজন নির্লোভ নির্মোহ ব্যক্তি ছিলেন তিনি। আজীবন ছিলেন প্রচার বিমুখ। কখনও কোনো বিলাসিতা তাকে স্পর্শ করেনি। পায়ে হেঁটে জোর বেশি রিকশা ভ্যানে চড়ে পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। কিডনী জটিলতা, লিভার ফাংশানিংয়ে জটিলতা, দৃষ্টি শক্তি হ্রাস পাওয়া, হৃদরোগ এসবই তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে ফেলেছিল। অক্টোপাসের এই প্যাচ থেকে তিনি আর বের হতে পারলেন না। বড়ই আফসোস। আগেই বলেছি তিনি পত্রিকার সম্পাদক। তিনিই পত্রিকার সাংবাদিক । আবার তিনিই পত্রিকার কম্পোজিটর। আবার কখনও কখনও তিনি নিজেই বিলি বণ্টন করেছেন তার পত্রিকা। যেনো কোনো খেদ নেই, কোনো দুঃখ নেই, কোনো কষ্টও নেই। বরং এতে সম্মান বোধ করেছেন তিনি। কচি ভাই, মুফতি আবদুর রহিম কচি হতে পারেন আমাদের সাংবাদিকদের জন্য এক অনুপ্রেরণা, এক পথপ্রদর্শক। লেখক ডিস্ট্রিক্ট : করেসপন্ডেন্ট, দৈনিক যুগান্তর ও এনটিভি।