তালা

তালার সংগ্রামী ৫ জয়িতার গল্প

By Daily Satkhira

July 02, 2017

অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী রেবেকা বেগম

অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী তালা উপজেলার হাজরাকাটি গ্রামের আলতাব সরদারের স্ত্রী রেবেকা বেগম। তিনি বলেন,“আমার সংসারে অনেক মানুষ। ছেলেমেয়েদের দু’বেলা খাওয়ানোর মত টাকা আয় হত না। দু’জনে আয় করে যা আয় হত সকলে দু’বেলা খাওয়া চলত না। তখন একজনের কাছ থেকে একটা গরু নেই। নিজেদের খাওয়া যোগাতে পারি না, গরুর খাবার তারপরে গরুটা বড় করে সেটা থেকে একটা বাচ্চা হয় এবং মালিক সেটা আমাকে দিয়ে দেয়। সংসারে অভাবের কারণে বাড়ি থেকে সকলে মিলে কাজের জন্য ঢাকায় চলে যায়। একজনের আয়ে সেখানে আমাদের চলছিল না। দীর্ঘ ৫/৬ বছর আমরা ঢাকায় থাকি তারপর বাড়িতে এসে আমরা ঐ গরুটা পালন শুরু করি। আস্তে আস্তে আমার অনেক গরু হয়। মাসে অনেক টাকার দুধ ও মশাল বিক্রি করে। বছরে কমপক্ষে ৪/৫ শত মশাল বিক্রি করি। বর্তমানে আমার গোয়ালে কয়েক লক্ষ টাকার গরু রয়েছে। এভাবে আস্তে আস্তে আমার অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয়। ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। তারা সকলে স্বামীর বাড়িতে ভাল আছে। আর সকল সমস্যা এর মাধ্যমে সমাধান করি। প্রায় ৫/৬ বিঘা জমি বন্ধক রেখে সেখানে ফসল ফলাচ্ছি। এখন আমার মাসে অনেক টাকা আয় হয়। বর্তমানে আমাদের সংসারে কোন অভাব নাই। আমি এভাবে আমার অবস্থার পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছি। আল্লাহ আমার সকল আশা পূরণ করে দেন। আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ। দু’বেলা পেট ভরে খেতে পারতাম না। এখন বর্তমানে লক্ষ টাকার মালিক হতে পেরেছি। আমার বাড়িতে বর্তমানে অনেক গরু ছাগল রয়েছে। সংসার ভাল ভাবে চালাতে পারছি। তাই এখন আমি আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বি।”

শিক্ষা ক্ষেত্রে সাফল্য অজর্নকারী নারী তন্নি রায়

শিক্ষা ক্ষেত্রে সাফল্য অজর্নকারী নারী তালা উপজেলার গোপালপুর গ্রামের রামপ্রসাদ রায়ের কন্যা তন্নি রায়। তিনি বলেন,“ আমি লেখাপড়া করতাম। আমি যখন একাদশ শ্রেণিতে পড়তাম, তখন আমার মা বাবা আমাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। তারা আমাকে কিছুদিন লেখাপড়ার সুযোগ করে দেয় পরে লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে বলে এবং গ্রামের বাড়িতে নিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন শুরু করে। অনেক সহ্য করে স্বামীর বাড়িতে চেষ্টা করেও লেখাপড়া করতে পারিনি। পরে বাবার বাড়িতে আসি। অনেক ঝগড়া বিবাদের পরে আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তখন কোন দিশা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। লেখাপড়া শুরু করি। পরীক্ষায় এ গ্রেডে উত্তীর্ণ হই। পরে নার্সিং পেশা অর্থাৎ মানুষের সেবা করার জন্য এখানে লেখাপড়ার চেষ্টা করি ও চান্স পেয়ে যায়। পরে সকল প্রতিকূলতা অতিক্রম করে নার্সিং পড়া শুরু করেছি। নার্সিং শেষ করে হাসপাতালে যোগদান করে মানুষের সেবায় আমি নিয়োজিত থাকব। মানুষের সেবা করাই আমার ধর্ম। এটা মনে করে সামনের দিন গুলো কাটাতে চাই। বাবার আর্থিক অবস্থা অনেক খারাপ। তারপরও বাবা চেষ্টা করেছেন আমার লেখাপড়া করে মানুষ করার জন্য। পরম করুনাময় আমার আশা যেন পূরণ করেন। এটাই আমার একান্ত কাম্য। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে পুনরায় লেখাপড়া শুরু করেছি। এখন আমি অনেক ভাল অবস্থানে চলে এসেছি। আমাদের গরীব পরিবারের পক্ষে লেখাপড়া করানোর হচ্ছে না তারপরেও অনেক কষ্টা সহ্য করে পুনরায় লেখাপড়া শুরু করেছি। লেখাপড়া শেষ করে মানুষের সেবা করে যাব।”

সফল জননী অনিমা দেবনাথ

সফল জননী নারী তালা উপজেলার গোপালপুর গ্রামের মৃত: দিলীপ দেবনাথের স্ত্রী। তিনি বলেন,“আমার স্বামী ছিল মানসিক প্রতিবন্ধী। আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। সংসার চালানোর মতই কিছুই ছিলন না। স্বামীর সাথে ঘর সংসার চলাকালীন আমার তিনটি কন্যা সন্তান হয়। শত প্রতিকূলতা দারিদ্রতার সাথে আমি আমার সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। বিগত ৫ বছর পূর্বে আমার স্বামী মারা যায়। আমার স্বামী মানসিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় এলাকার মানুষ আমাকে অনেক অত্যাচার করেছে। যে আমি বাড়িঘর ছেলে অন্যত্র চলে যায়। কিন্তু শত প্রতিকূলতা ও দারিদ্রতার মাঝে ছেলেমেয়েদের মানুষ করার চেষ্টা করেছি। আমার সন্তানেরা পড়ালেখা ভালভাবে যাতে করতে পারে চেষ্টা করছি। সে জন্য আমি মাঠে কাজ করি। তিন সন্তানের লেখাপড়া, তাদের পোশাক পরিচ্ছদ, খাওয়া দাওয়া সুষ্ঠভাবে আমার পক্ষে পরিচালনা করা ছিল খুবই অসাধ্য। দু’মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ছোট মেয়েকে কুমিরা মহিলা কলেজে বাংলা বিভাগে ৪র্থ বর্ষে অনার্স পড়াচ্ছি। তাকে লেখাপড়া শিখিয়ে সমাজে মানুষের উন্নয়নে কাজ করার আশা করছি। আমি সমাজের মানুষের জন্য কাজ করি। আমি ব্র্যাকের একজন সেবিকা হিসেবে এলাকার মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আমি শত দুঃখ কষ্ট সহ্য করে মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে পেরে আমি গর্বিত বোধ করি।”

নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে কাজ করছেন তাসলিমা

তালা উপজেলার ভায়ড়া গ্রামের আব্দুর রশিদ এর কন্যা তাসলিমা খাতুন। তিনি বলেন,“ আমার বিয়ের এক বছরের মধ্যে স্বামী আমাকে তালাক দেয়। আমার গর্ভে তখন বাচ্চা ছিল। তারপর এক তালাক করে আমার মা বাবা উভয়ই মারা যায় ছোট একটা ভাই রেখে। কিভাবে সংসার চলবে জানতাম না। কাজের জন্য বাড়ির বাহির হয়ে যায়। লোকের বাড়ি কাজ করতাম। যা পাইতাম তাতে তিন জনের দু’বেলা সংসার চলত না। লোকের বাড়ি থেকে চেয়েও এনে খেয়েছি। ছোট ভাই স্কুলে যাওয়ার মত ছিল সে লেখাপড়া করত। আমার মত যেন তার কপাল না পোড়ে সেজন্য তার লেখাপড়া বন্ধ করিনি। রাজমিস্ত্রীর সাথে জোগাড়ির কাজ করতাম। যেটা পাইতাম তা দিয়ে দু’বেলা কোন রকম সংসার চলত। থাকার মত কোন ভাল জায়গা ছিল না। তালায় এসে বাসা ভাড়া করে থাকতাম। এভাবে চলতে চলতে আমার ভাই ৫ম শ্রেণিতে বৃত্তি লাভ করে। অষ্টম শ্রেণিতে গোল্ডেন এ প্লাস নিয়ে পাস করল। এসএসসি তে গোল্ডেন এ প্লাস ও এইচএসসিতে এ প্লাস পেয়েছে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ছে। আমার ছেলে ও ভাইকে মানুষ করার চেষ্টা করে সফল হয়েছি। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে বর্তমানে নতুন উদ্যোগে কাজ শুরু করে এখন আমি সফল হয়েছি। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে বর্তমানে ভাই ও ছেলেকে মানুষ করে নিজেও পূর্বের তুলনায় অনেক ভাল অবস্থানে চলে আসতে পেরেছি। আমার মত অসহায় মেয়ে ভাইতে ঢাকা ভার্সিটিতে পড়াতে পারাটা কতটা কষ্টকর তারপরেও আমি সফল হয়েছি।”

সমাজ উন্নয়নে অসমান্য অবদান রেখেছেন জাকিয়া সুলতানা ইতি

সমাজ উন্নয়নে অসমান্য অবদান রেখেছেন তালা উপজেলার কলিয়া গ্রামের বাসিন্দা জাকিয়া সুলতানা ইতি। ১৯৯৭ সালের ৪ এপ্রিল বিবাহ হয় কলিয়া গ্রামের মো: শামছুর রহমান মোড়লের পুত্র শামীম কবিরের সাথে। স্বামীর সাথে সংসার করে দু’টি কন্যা সন্তানের জননী হয়। স্বামীর সংসার সামলিয়ে সমাজের মানুষের পাশে দাঁড়ায়। বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবেলা করে ও বাল্যবিবাহ রোধের জন্য সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিতে বহুমুখী কার্যসম্পাদন করে। দেখতে দেখতে স্বামীর সংসার ১১ বছর পার করতে না করতে হঠাৎ ২৮ ই জুন ২০০৮ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে গভীর রাতে স্বামীর মৃত্যুবরণ হয়। বিধবা জাকিয়া সুলতানার অবুঝ দুধের বাচ্চাসহ দুই কন্যা সন্তানকে নিয়ে মানসিক ও আর্থিক ভাবে নির্যাতনের মুখোমুখি হয়। তখন সে নারী উন্নয়ন সংস্থার সাথে বিভিন্ন ধরনের সমাজ উন্নয়ন মূলক কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে। অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মধ্য দিয়ে সময় দিতে থাকে অসহায় মানুষের কল্যাণের জন্য। অদম্য পরিশ্রম করে প্রতিরোধ করেছে বাল্য বিবাহ। উৎসাহ দিয়েছে শতশত কিশোরী মেয়েদের। স্বপ্ন দেখিয়েছে তাদের উজ্বল ভবিষ্যতের। কখনো মা বাবাকে বুঝিয়েছে, কখনো কাজীকে বাল্য বিবাহ রোধের জন্য পরামর্শ দিয়েছে আবার কখনো কিশোরী মেয়েদের বাল্য বিবাহের ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে গানের মাধ্যমে সচেতন করেছে। তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের ১৭ গ্রামের প্রতিটি বাড়ির কিশোরী মেয়েরা জাকিয়া আপাকে চেনে। পায়ে হেঁটে সময় পেলে সকলের বাড়িতে যায়। কিন্তু ক্ষমতা ও আইনের ফাঁক ফোকরের অজুহাত দেখিয়য়ে গোপনে গোপনে বাল্য বিবাহ চলতে থাকে। এই বাল্য বিবাহের দৃশ্য দেখে হতাশ হন জাকিয়া সুলতানা। তখন সমাজের মানুষের কান কথাকে উপেক্ষা করে বিধবা জাকিয়া সুলতানা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত হন। বর্তমানে তিনি- নারী উন্নয়ন সংস্থার পরিচালনা পরিষদের সদস্য, শতদল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সদস্য, উত্তরণ সংস্থার বিনামূল্যে আইন সহায়তা প্রকল্পে ইউনিয়ন কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট তেঁতুলিয়া শাখার সদস্য। এ সকল প্রতিষ্ঠানে পরিচালনা পরিষদের দায়িত্বে থেকে সমাজ উন্নয়নের হাতকে শক্তিশালী করেন। কিন্তু বাল্য বিবাহ দৃষ্টিভঙ্গির অসচেতন ব্যক্তিরা বিভিন্ন অসাধু উপায়ে একের পর এক বাল্য বিবাহ দিয়ে থাকে। সমাজের বিভিন অনিয়ম প্রতিরোধ, সামাজিক উন্নয়ন ও বাল্য বিবাহ রোধে উদ্দেশ্যে ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত ৭, ৮, ৯ নং ওয়ার্ডের সদস্য পদে নিজেকে দাঁড় করায়। তার অদম্য চেষ্টা, সাহসী, ত্যাগী, কর্মঠ মহিলার সদিচ্ছা দেখে বিপুল জনসমর্থন দিয়ে সমাজের মানুষ তাকে ইউনিয়ন পরিষদের মহিলা মেম্বর বানায় ২২ মার্চ ২০১৬ ইং তারিখে। বর্তমানে জাকিয়া সুলতানার হাত অনেক শক্তিশালী। ৫ নং তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের কোথাও বাল্য বিবাহ হতে থাকলে এলাকার মানুষ জাকিয়া আপাকে জানায়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, এনজিও প্রতিনিধি, ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বরগণ জাকিয়া আপার ডাকে সাড়া দেয়। ঝাঁপিয়ে পড়ে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে। অনেক বাল্য বিবাহ বন্ধ করেছে। কিশোরী মেয়েদের বিভিন্ন ধরনের সচেতনতা প্রশিক্ষনের মাধ্যমে উজ্বল ভবিষতের দিকে নিয়ে গেছে। তার বড় কন্যা এইচএসসি পরীক্ষার্থী ও ছোট কন্যা ষষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত বর্তমানে তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার SDG অর্জনে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। সূর্য উদয় থেকে অস্ত যাওয়া পর্যন্ত বিরামহীনভাবে অসহায় মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন। আর বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে সমাজ উন্নয়নে অসামন্য অবদান রেখে চলেছেন। তাই তিনি নিজের ভাষায় বলতে চান- “মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই”।