সাতক্ষীরা

জেলা পরিষদের মহাদুর্নীতিবাজ মাহাবুব অবশেষে বগুড়ায় বদলি

By Daily Satkhira

July 12, 2017

এম. বেলাল হোসাইন : সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের ষাটলিপিকার থেকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতির পর বদলির আদেশের বিরুদ্ধে এসএম মাহাবুবর রহমানের হাইকোর্টে দায়েরকৃত রুলনিশি খারিজ করা হয়েছে। বুধবার হাইকোর্টের বিচারপতি কাজী রেজাউল হক ও মোহাম্মদ উল্লাহ এর যৌথ বেঞ্চ এ রুলনিশি খারিজ করেন। ফলে বগুড়া জেলা পরিষদে যোগদান করা ছাড়া মাহাবুবর রহমানের আপাততঃ অন্য কোন উপায় থাকছে না। এদিকে এ আদেশ কার্যকর হলে সাতক্ষীরা জেলা পরিষদে মাহাবুবর রহমানের ২৭ বছরের রামরাজত্বের অবসান ঘটবে বলে মনে করেন ভুক্তভোগীরা। সাতক্ষীরা জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, এস,এম মাহবুবুর রহমানকে ১৯৯০ সালের ২৯ এপ্রিল ষাটলিপিকার (টাইপিষ্ট) হিসাবে জেলা পরিষদে অস্থায়ী নিয়োগ পান। ২০০১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি একই অফিসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে তিনি পদোন্নতি পান। স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় ২০০১ সালের ২৬ জুন এস,এম, মাহবুবর রহমানকে পঞ্চগড় জেলা পরিষদে বদলি করেন। উক্ত বদলি আদেশকে চ্যালেজ্ঞ করে তিনি হাইকোর্টে ৩৪৪৬/২০০১ নং রীট পিটিশন দায়ের করেন। ৪ আগষ্ট শুনানী শেষে আদালত উক্ত বদলি আদেশের উপর স্থগিতাদেশ জারি করে পরদিন বিবাদীগনের বিরুদ্ধে রুলনিশি জারী করেন। ২০০৫ সালের ১১ জানুয়ারি ১নং বিবাদী স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সহকারি এটর্নি জেনারেল ব্যারিষ্টার সৈয়দা আফছার জাহান ওই রীট মামলায় আদালতে হাজির হয়ে জবাব প্রদান করেন। ওই বছরের ২৪ মে বাদি মাহাবুবর রহমান রিট মামলাটি প্রত্যাহারের জন্য সংশ্লিষ্ট আদালতে আবেদন করেন। পরদিন শুনানী শেষে আদালত আবেদন মঞ্জুর করে। স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় পুনরায় ২০০৫ সালের ১৪ জুন এস,এম, মাহবুবুর রহমানকে জামালপুর জেলা পরিষদে বদলি করেন। তিনি জামালপুর জেলা পরিষদে যোগদানের জন্য আবেদন করলেও যোগদানপত্র গৃহীত হয়নি। অপরদিকে গত ২০০৫ সালের ১৯ আগষ্ট সাতক্ষীরা জেলার চার জন সংসদ সদস্য এস,এম মাহবুবের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে এক ডিও লেটার প্রদান করেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে। ওই ডিও লেটারে প্রশাসনিক কর্মকর্তা এসএম মাহাবুবর রহমানের বিরুদ্ধে শ্যামনগর উপজেলা পরিষদের মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের ৬৪টি গৃহ বন্দোবস্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে অর্ধ কোটি টাকা উৎকোচ গ্রহণ, জেলার বিভিন্ন খেয়াঘাট লক্ষ লক্ষ টাকা উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে পূর্ববর্তী ডাকের চেয়ে কম ডাকে ইজারা দেওয়া, নিজের এলাকার ও নিজ আত্মীয় স্বজনদের জেলা পরিষদে চাকুরি দিয়ে সি-িকেটের মাধ্যমে গডফাদার হিসেবে আত্মপ্রকাশ, একজন নিম্নমানের কর্মকর্তা হয়েও প্রধান নির্বাহীর মত উচ্চ মানের বর্মকর্তাকে হয়রানি ও হেনস্তার মধ্য দিয়ে বদলি করার কথা তুলে ধরা হয়। সাংসদরা আরো উল্লেখ করেন যে, অনেকগুলো অভিযোগকারির অভিযোগের ভিত্তিতে তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোঃ জসিমউদ্দিন তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে মাহবুবর রহমানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দূর্ণীতির প্রমানসহ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসক স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন। ডিও লেটারে মাহাবুবর রহমানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ অথবা তার বিরুদ্ধে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠনের মাধ্যমে তদন্ত করার জন্য দাবি জানানো হয়। কিন্তু কোন এক অদৃশ্য কারণে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ২০০৫ সালের ১৪ জুন বদলি আদেশ চ্যালেঞ্জ ও একই বছরের ১৯ আগষ্ট চার সাংসদের উদ্দেশ্য প্রণোদিত ডিও লেটারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মাহবুববর রহমান হাইকোর্টে -৬৯১৭/২০০৫ নং রীট পিটিশন দায়ের করেন। সেখানে সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী ভুইয়া মোঃ আতাউর রহমানের ২০০৩ সালের ১৭ জুনের একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। প্রতিবেদনে সাতক্ষীরা জেলা ন্যাপ এর সাধারণ সম্পাদক কাজী সাঈদুর রহমানের অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করা হয়। ১২ সেপ্টেম্বর আদালত শুনানীন্তে উক্ত আদেশের উপর রুল জারী করেন এবং বদলি আদেশ স্থগিত করেন। স্থগিতাদেশ থাকা অবস্থায় পরবর্তীতে তিনি সাতক্ষীরা জেলা পরিষদ থেকে তাহার বেতন ভাতা এবং রীট নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত চাকুরীতে যাহাতে স্থিতিবস্থা বজায় থাকে সে জন্য তিনি ২০০৫ সালের ৮ অক্টোবর একটি আবেদনপত্র দাখিল করেন এবং তা’ মঞ্জুর হয়। যাহা বর্তমানে বিচারাধীন। এরপরও স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় ৬৯১৭/২০০৫ নং রিট পিটিশনে দীর্ঘদিন আদালতে হাজির হয়ে জবাব দাখিলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। এদিকে বদলি সংক্রান্ত একটি রীট পিটিশনের কার্যক্রম চালু থাকার পরও গত বছরের ৮ মে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়র উপ সচিব জুবাইদা নাসরিন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে প্রশাসনিক কর্মকর্তা এস,এম মাহবুবুর রহমানকে বগুড়া জেলা পরিষদে বদলি করেন। এ বদলির আদেশের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত রীট পিটিশনের কার্যক্রম চালু থাকার পরও নতুন করে দেওয়া বদলি আদেশেকে চ্যালেঞ্জ করে এসএম মাহবুবর রহমান বিষয়টি সংশ্লিষ্ট আদালতকে অবহিত না করে পুনরায় ৭৩৩৩/২০১৬ নং রীট পিটিশন দায়ের করেন। শুনানীন্তে উক্ত বদলি আদেশ তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন আদালত। ওই রীট মামলায় স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় দীর্ঘদিন আদালতে হাজির হয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। অন্যদিকে ২০০১ সালে বদলি আদেশ স্থগিত করার জন্য জেলা পরিষদের তৎকালিন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাহাবুবর রহমানকে সাতক্ষীরা জেলা পরিষদে রাখার স্বপক্ষে একটি আবেদন পত্রের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেন। একইভাবে ২০১৬ সালের বদলি আদেশ বাতিল করার জন্য গত বছরের ১২ মে জেলা পরিষদ প্রশাসক মুনসুর আহম্মেদ তাঁর নিজস্ব প্যাডে মাহাবুবর রহমানকে একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও চার জামায়াত সাংসদ তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করাসহ দক্ষ এ প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে অন্যত্র বদলি করা হলে সমূহ ক্ষতি হবে বলে সম্পুর্ন মিথ্যা মাননীয় মন্ত্রী, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এ এক আবেদন করেন। গত বছরের ৩০ মে প্রায় একইভাবে একই মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন প্রধান নির্বাহী মোঃ মনিরুজ্জামান। আবেদনপত্রে একটি রীট পিটিশনের কার্যক্রম শুনানী শেষ না হওয়ার আগে গত বছরের ৮ মে উপসচিব জুবাইদা নাসরিন স্বাক্ষরিত বগুড়া জেলায় এসএম মাহবুবর রহমানের বদলির আদেশটি সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিটি রীট পিটিশনে মাহাবুবর রহমানের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান সংক্রান্ত কাগজপত্র জমা না দিয়ে ষাটলিপিকার হিসেবে যোগদানের কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়। বিগত জেলা পরিষদ নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগর সাধারণ সম্পাদক মোঃ নজরুল ইসলাম জয়লাভ করার পর জেলা যুবলীগের এক শীর্ষ নেতার উপস্থিতিতে লাঞ্ছিত জনগন মাহাবুবর রহমানকে তার অফিসের চেয়ার থেকে তুলে এনে নাকখত দেওয়া, পুকুরের ঘাট পরিষ্কার করাসহ বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত করে বলে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ছাপা হয়। এ ঘটনায় তিনি কোন প্রতিবাদ না করে ওই যুবলীগ নেতার সঙ্গে আপোষ করে নেন। এবং পুরষ্কার হিসেবে তার বাবার নামীয় একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব দেন। এদিকে হাইকোর্টের নির্দেশে জেলা পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এসএম মাহবুবর রহমানের বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ১৮ আগষ্ট ‘গৃহ নির্মাণের তালিকা তৈরিতে দূর্ণীতির অভিযোগ’অনিয়ম সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে জলবায়ু ট্রাষ্ট ফা-ের আওতায় গৃহনির্মাণের তালিকা তৈরিতে প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাহবুবর রহমান ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা উৎকোচ গ্রহণ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়। এ নিয়ে হাইকোর্টে রিটকারিদের পক্ষে আইনজীবী অ্যাড. সত্যরঞ্জন ম-লের বাড়িতে হামলা চালায় মাহাবুবুর রহমানের লোকজন। এতেও দুর্বল করতে না পারায় তার বিরুদ্ধে কালিগঞ্জ উপজেলার কুমারখালি গ্রামের দীপঙ্কর ম-ল ও আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর গ্রামের নুরুজ্জামান গাজীকে দিয়ে আদালতে পৃথক দু’টি মামলা করানো হয়। যদিও মাহাবুবর রহমান ওই হামলা ও মামলার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন। অ্যাড. সত্যরঞ্জন ম-ল স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখে মাহাবুবর রহমানের বদলি আদেশ স্থগিত সংক্রান্ত দায়েরকৃত রিট পিটিশনের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আইনজীবী নিয়োগ দেওয়ার জন্য চিঠি দেন। এরই প্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে মোঃ আশরাফুল আলম আদালতে ভোকালতনামা জমা দেন। বুধবার বিচারক কাজী রেজাউল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহ উভয়পক্ষের শুনানী শেষে মাহাবুবর রহমানের দায়েরকৃত রীট পিটিশনের রুলনিশি খারিজ করে দিয়ে সরকারি কর্মচারি হিসেবে বদলি হতে হবে বলে আদেশ দেন। রীটকারি পক্ষের আইনজীবী ছিলেন অ্যাড. মোহন। স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষে আইনজীবী মোঃ আশরাফুল আলম ও ডেপুটি এটর্নি জেনারেল হিসেবে অ্যাড. তাপস কুমার পাল দায়িত্ব পালন করেন। জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষে দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনজীবী মোঃ আশরাফুল আলম বলেন, আদেশ সাতক্ষীরা জেলা পরিষদে পৌঁছানোর পর মাহাবুবর রহমানকে বগুড়ায় যোগদান করা ছাড়া অন্য কোন উপায় থাকবে না। সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এসএম মাহাবুবর রহমানের কাছে বুধবার সন্ধ্যায় জানতে চাইলে তার ০১৭১১-৩৫২৭২০ মুঠো ফোনটি রিসিভ করেননি তিনি।