বিনোদন

অতল অন্ধকারে হারাচ্ছে বাংলা চলচ্চিত্র!

By Daily Satkhira

July 13, 2017

বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদপুরুষ সত্যজিৎ রায় তাঁর রচিত চলচ্চিত্র-রচনা, আঙ্গিক, ভাষা ও ভঙ্গি প্রবন্ধে বলেছেন, নাটকের দ্বন্দ্ব, উপন্যাসের কাহিনী ও পরিবেশ বর্ণনা, সংগীতের গতি ও ছন্দ, পেইন্টিং সুলভ আলোছায়ার ব্যঞ্জনা এসবই চলচ্চিত্রে স্থান পেয়েছে। কিন্তু ইমেজ ও ধ্বনির যে ভাষা, দেখানো-শোনানোর বাইরে যার প্রকাশ নেই, সে একেবারে স্বতন্ত্র ভাষা। ফলে বক্তব্য এক হলেও ভঙ্গির তফাৎ হতে বাধ্য। এ ভঙ্গি চলচ্চিত্রের বিশেষ ভঙ্গি। তাই অন্য শিল্প-সাহিত্যের লক্ষণ থাকা সত্ত্বেও চলচ্চিত্র অনন্য।

এমন অনন্য শিল্পের ধারক ও বাহক অথবা সব পর্যায়ের কুশীলব যাঁরা হন, তাঁদের জ্ঞানবুদ্ধি আর চিন্তা-চেতনাটা নিশ্চিতই হওয়া উচিত সমাজের আর পাঁচটা মানুষের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা, বুদ্ধিদীপ্ত ও উচ্চমার্গীয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই চলচ্চিত্র পরিবারের সঙ্গে যুক্তরা সাধারণের কাছে তারকা খ্যাতিসম্পন্ন হন। তাঁদের একনজর দেখবার জন্য এবং তাঁদের কথা শোনার জন্য মুখিয়ে থাকেন সবাই। চলচ্চিত্র তারকাদের অঙ্গভঙ্গি, কথাবার্তা, স্টাইল, ফ্যাশন এবং চালচলন অনুসরণ করাটাও সাধারণের রোজকার অভ্যাস। কিন্তু চলচ্চিত্রের সেই মানুষরা যদি হোন বিপথগামী? তাঁদের আচরণ যদি হয় পাড়াগাঁওয়ের স্বার্থপর যাচ্ছেতাই মোড়লদের মতো? তবে বাংলা সিনেমার চিরায়ত সংলাপটা মনে করা ছাড়া আর গতি থাকে না, ‘ছেড়ে দে শয়তান!’

গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ইফতেখার উদ্দিন নওশাদের ওপর হামলায় অভিযোগে চিত্রনায়ক রিয়াজ, খল অভিনেতা মিশা সওদাগর ও খোরশেদ আলম খসরু প্রযোজিত সিনেমা হলে প্রদর্শন না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এ ঘোষণা দিয়েছেন চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির নেতারা। কেউ কি কখনো ভাবতে পেরেছিলেন, একজন শিল্পী তাঁরই সহশিল্পী বা চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্টের গায়ে হাত তুলতে পারেন? এই একটা উদাহরণই বাংলা চলচ্চিত্র পরিবারের এ সময়ের অধঃপতন ও নিমজ্জন প্রমাণে যথেষ্ট। কিন্তু ঘটনা কেবল এটা নয়। গেল কয়েক মাস ধরেই যৌথ প্রযোজনার ছবি ও দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (সাফটা) আলোকে কলকাতার সঙ্গে চলচ্চিত্র বিনিময় নিয়ে সিনেমাপাড়া বেশ সরগরম। একপক্ষ এসব চুক্তি মেনে কলকাতা থেকে আধুনিক নির্মাণশৈলীর সিনেমা এনে হলে প্রদর্শন করে দেশীয় সিনেমার বাজারকে ঝুঁকির মুখে ফেলছেন। আবার আমাদের এখান থেকে বিনিময়ে যেসব চলচ্চিত্র কলকাতায় পাঠানো হচ্ছে, সেসব দেখবার রুচি সে দেশ বা এ দেশের দর্শকদের কারোরই নেই। এমন এক পরিস্থিতিতে যে যেভাবে পারছেন, একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন, দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। ফেসবুকে বা টেলিভিশনের লাইভ অনুষ্ঠানে প্রতিপক্ষের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কুৎসা রটনা পর্যন্ত করছেন।

সিনিয়র অভিনেতাদের অসম্মান করে বক্তব্য দিচ্ছেন অনেকে। আবার সিনিয়ররা অনেককে আগুনে ঝাঁপ না দিতে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। সিনিয়র আর্টিস্ট মৌসুমীকে বয়স্ক বলেছেন মিশা সওদাগর। আর কী চাই? ওমর সানী নিজের রেস্টুরেন্টে বসে ফেসবুক লাইভে মিশাকে একহাত নিয়েছেন। অবস্থাটা এমন যে কেউ কারো কথাই সইতে পারছেন না।

চলচ্চিত্র শিল্পী বা পরিচালক সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একে অপরকে ঘায়েল করার বিষয়টি এতটা খেলো দেখঅ গেছে যে তাতে অনুমান করা যায়, জাতীয় রাজনীতির নোংরা ধারাটা চলচ্চিত্র পাড়াতেও ভালোই সংক্রমিত হয়েছে। কিন্তু চলচ্চিত্রের মতো একটা শক্তিশালী শিল্পমাধ্যমের পরিবেশটা এভাবে এতটা কলুষিত হতে আছে? শিল্পীদের কি এমনতর ঝগড়া-কলহ-নোংরামি সাজে?

যে যেভাবে পারছে, যখন তখন যাকে তাকে বহিষ্কার করছে, এফডিসিতে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করছে। কারো মধ্যে এখন আর স্থৈর্য নেই, একে অপরের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধটুকু অবশিষ্ট নেই।

শিল্পীরা এতটা অহংকারী হয়ে উঠেছে যে নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে মানুষ বলেই গণ্য করছেন না। তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনেও অন্ধকারচর্চাটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। শাকিব খান, অপু বিশ্বাস, তাঁদের সন্তান আব্রাম ও অপর নায়িকা বুবলীকে নিয়ে যে বাস্তবধর্মী সিরিওকমেডি গত কিছুদিন দেখল সবাই, তা যেকোনো ফিকশনধর্মী জটিল গ্রাম্য চলচ্চিত্র গল্পকেও হার মানিয়েছে। কিন্তু একজন নাগরিক শিল্পীর কি বাস্তবজীবনেও গ্রামীণ লোভী মাতবর সাজলে চলে?

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে তথ্য মন্ত্রণালয়, এফডিসি, সেন্সর বোর্ড, বাংলাদেশ টেলিভিশন, শিল্পী-পরিচালক-প্রযোজক সমিতি, তারা কি চলচ্চিত্র পরিবারের মূল্যবোধের এমন অবক্ষয়ের বিষয়টি টের পাচ্ছেন না?

শিল্পীদের তো মহত্ত্ব চর্চা করবার কথা, মহানুভব হয়ে উঠবার কথা। তিনি হবেন অনুসরণীয়, অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। কোথায় হারিয়ে গেল রাজ্জাক-কবরী, শাবানা-আলমগীর বা ববিতা-জাফর ইকবালদের আমল? পুঁজিবাদ আর সস্তা জনপ্রিয়তাই কি তবে সব গিলে খাচ্ছে। চলচ্চিত্র পরিবারের এই অবক্ষয়টাতে মিডিয়াও তাঁদের স্বার্থ বুঝে হাওয়া দিচ্ছে। শিল্পীরা যে নিজেরাই মারামারি-গালাগালি করে নিজেদের অধঃপাতে নিয়ে যাচ্ছে, এ নিয়ে কারো মুখে কোনো রা নেই। কোনো সুশিক্ষিত বা স্বশিক্ষিত মানুষ কি আমাদের চলচ্চিত্র পরিবারে নেই?

এমন এক হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতিতে ভালো চলচ্চিত্র আশা করা যায় কি? এখনো চলচ্চিত্রের আবেদন সব শিল্পের ওপরে। বৈশ্বিকভাবে চলচ্চিত্রের যে আধুনিকায়ন হয়েছে তার ছিটেফোঁটাও কি বাংলাদেশে আছে? উৎকর্ষতায় নিজেদের ছাড়িয়ে যাওয়ার সদিচ্ছা কারোর মধ্যে না থাকুক একে অপরকে নিচু করবার ক্ষেত্রে কারো আগ্রহের সীমা-পরিসীমা নেই। বছরে দু-চারজন পরিচালকের হাতে খুব স্বল্প সংখ্যক ভালো চলচ্চিত্র নির্মিত হলেও নানা চাপে পড়ে সেসব আর পাদপ্রদীপের আলোয় আসে না। সার্বিকভাবে বাংলা চলচ্চিত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। নিতান্ত বাধ্য হয়ে তারা ঝুঁকছে কলকাতা, মুম্বাই আর হলিউডে।

নন্দনতাত্ত্বিকদের মতে, শিল্প শিল্পীর অনুভবকে, অনুভূতিকে প্রকাশ করে। একজন শিল্পীর শিল্পসত্তা অনির্ভর, অসীম ও ক্ষয়হীন। শিল্প ও শিল্পীর মাধ্যমেই মহাসত্তার প্রকাশ। শিল্পের গোড়ার কথাই হলো ‘রিয়েলিটি’ বা পরম সত্যকে প্রকাশ করা। আর মহত্তম শিল্প থেকেই তার কাঙ্ক্ষিত সত্য ও সুন্দরকে খোঁজে পায় শিল্পরসিক। কিন্তু আমাদের চলচ্চিত্র পরিবারে মহত্তম শিল্প বিনির্মাণ করতে পারেন এমন শিল্পী কোথায় পাব? আলো নয়, মননশীলতা নয়, অতল অন্ধকারকেই যে আমরা গন্তব্য করে চলেছি!

ফারদিন ফেরদৌস : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।