সবার ওপরে মানুষই সত্য। তার ওপরে কিছুই নেই, থাকতে পারে না। পৃথিবীর সবকিছুই মানুষের জন্য। কোনোকিছুর ওপর মানুষ নির্ভরশীল নয়, পৃথিবীর সবকিছুই মানুষের ওপর নির্ভরশীল। মানুষের জন্যই পৃথিবী। পৃথিবীর জন্য মানুষ নয়।
এই রাষ্ট্র আমার কাছে ঋণী। আমি মানুষ। যখন পৃথিবীতে রাষ্ট্র ছিল না, তখনও মানুষ ছিল। মানুষই রাষ্ট্রকে সৃষ্টি করেছে, রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান। কোনো আইন সংবিধানের ঊর্ধ্বে উঠতে পারবে না। কিন্তু, সংবিধান কি মানবতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারবে? না, পারবে না। রাষ্ট্র কি মানবতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারবে? সেটাও পারবে না। সবকিছুর ঊর্ধ্বেই মানুষ, মানবতা।
মানবতাকে, মানুষকে, মনুষ্যত্বকে কোনোভাবে, কোনো কালে কেউ অবহেলা করতে পারবে? অবজ্ঞা করতে পারবে? অপমান করতে পারবে? পৃথিবীর কোনো আইন কি এটাকে সাপোর্ট করে? রাষ্ট্রীয় আইন? ধর্মীয় আইন? মানবতার আইন? নৈতিকতার আইন? মানুষের উত্তর হলো- ‘না’। পারে না। পারবে না। পৃথিবী এখনো মানুষের। সৃষ্টির সেরা জীবের। এটা ভুলে গেলে চলবে না।
প্রশ্ন হলো, আমরা এ-কথা ভুলে যাচ্ছি কি না? আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে কেউ কেউ আইনের ঊর্ধ্বে বা মানবতারও ঊর্ধ্বে উঠছে কি না?
প্রশ্ন হলো, অন্যায়ভাবে, একজন নিরপরাধ মানুষকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে, জামিনযোগ্য অপরাধের সিআর মামলায় আইনের নজিরবিহীন ‘মহান প্রয়োগে’ তাকে কারাগারে বন্দি করা হচ্ছে কি না? আমরা কি ভেবে দেখছি, কারাগারে অন্যায়ভাবে ব্যক্তি নয়, আবদ্ধ হচ্ছে মানুষ, আবদ্ধ হচ্ছে মানবতা!
মানবতা, তোমার কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। মানুষ হয়েও তোমাকে অর্জনের যোগ্যতা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত কিছু ‘মানুষ’-এর নেই। আমাকে ক্ষমা করো। ক্ষুদ্র এ-আমার বড় জানতে ইচ্ছে করে, মানুষ কি অন্যায়ভাবে, বেআইনিভাবে, মনুষ্যত্বকে-বিবেককে নির্বাসনে পাঠিয়ে মানুষকে অপমান করে বড় হতে পারে? নাকি মানুষকে সম্মান দিয়েই মানুষ বড় হতে পারে?
আইনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই তো মানুষ। কোনো পশু নয়, কীট নয়, দানব নয়; আইনের আশ্রয় নেবে মানুষ, আইনের প্রয়োগও করবে মানুষ। একজন মানুষ কী করে আরেকজন মানুষকে বিনা অপরাধে ফাঁসিয়ে দিতে চায়? ‘নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত’ স্থাপন করে, মানবতাকে অন্যায্য-অনৈতিকভাবে অপমান করে কীভাবে একজন ‘মানুষ’ নিজেকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করার সাহস রাখে? এত বড় ঔদ্ধত্য আসে কোত্থেকে? এর মূল কোথায়? মানবতার স্বার্থে এই মূল সমূলে উপড়ে ফেলতে হবে। অনুসন্ধান করতে হবে ‘কারণ’-এর।
ভেবে দেখতে হবে, কেউ কঞ্চি হয়ে বাঁশের চেয়ে বড় হতে চায় কি না, কুয়োর ভেতরে থেকে কেউ নিজেকে কুয়োর চেয়েও বড় ভাবে কি না, গায়ের জোরে কেউ ধরাকে সরাজ্ঞান করতে চায় কি না, গাঁয়ের মানা উচিত না, তারপরও কেউ নিজেকে “মহা-মোড়ল” ভাবে কি না। অনুসন্ধান করতে হবে। রাষ্ট্রের স্বার্থেই করতে হবে।
কারণ, যে নিরপরাধ মানুষটি উপজেলা পর্যায়ে রাষ্ট্রেরও প্রতিনিধিত্ব করে, প্রজাতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করে, তার যদি হয় এ-ই পরিণতি, না জানি সেই প্রজাতন্ত্রের, সেই রাষ্ট্রের অন্য মানুষগুলোর কী অবস্থা! ‘কাগজের পাতা ভরে’ সব খবর তো আর আসে না। ‘জীবনপাতার অনেক খবর’ অগোচরেই রয়ে যায়। অগোচরে রয়ে যাওয়া সেই খবরগুলোও মানুষের, সৃষ্টির সেরা জীবের।
পৃথিবীর জন্মের ৪০০ কোটি বছর। মানুষের জন্মের ২০ লক্ষ বছর। আধুনিক মানুষের ২০ হাজার বছর। প্রবহমান মহাকালের প্রবল স্রোতে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে মানবতাকে নিয়ে, মানবতার অস্তিত্ব নিয়ে আমাদের সবাইকে নতুন করে ভাবতে হবে।
কোথায় যাচ্ছে মানবতা, মনুষ্যত্ব? এ পৃথিবী কি ‘স্বার্থময়’ হয়ে উঠছে? ‘যা-কিছু আমার স্বার্থের বন্ধু, তা সঠিক, আর বাকি সবই মিছে’- এমন ‘মহান’ ফিলোসফির ‘অম্লান’ ভূত কি কারো মাথায় ভর করেছে? যদি ভর করে থাকে, তাহলে তা প্রিয় পৃথিবী আর প্রিয় মানবতার জন্য চরম শঙ্কার, লজ্জ্বার, অবজ্ঞা-অপমান আর অবহেলার। ঘুমানোর ভান করলে জাগানো যাবে না। আমরা যদি ‘ঘুমিয়ে’ থাকি, তবে আসুন, আড়মোড়া দিই, জেগে উঠি।
যেভাবেই হোক, যত কষ্টই হোক, জেগে উঠতেই হবে। না হলে এই পৃথিবী আর মানুষের থাকবে না। ‘মানুষের মুখোশে’ ভরে উঠবে মাটির পৃথিবী। একটি ‘মুখোশবিহীন পৃথিবীর’ জন্য, সত্যিকারের মানবতার জন্য, ‘সাম্যের গান’ আর ‘মানুষের গান’ গাইবার জন্য প্রচেষ্টার কমতি রাখলে চলবে কেন? পৃথিবী হতে হবে মনুষ্যত্বের। মানবতার। ভালোবাসার। মমতার। ভ্রাতৃত্বের।
মানবতা হোক সবার ওপরে। মানুষই থাকুক সবার শ্রেষ্ঠ। মনুষ্যত্ব হোক পরম ব্রত। সংকীর্ণতা, পরশ্রীকাতরতা দূর করে অন্যের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করি, অন্যের অধিকারকে নিজের মতো করে ভালোবাসি। ব্যক্তির স্বার্থে নয়, গোষ্ঠীর স্বার্থে নয়, সবকিছুই হোক মানবতার স্বার্থে, মানবতার কল্যাণে।
জয় হোক মানুষের। জয় হোক মানবতার। পৃথিবীর সকল মানুষ মুক্তি পাক সব ধরনের অন্যায়, বন্দিশৃঙ্খল থেকে। পৃথিবী হয়ে উঠুক মানুষের পৃথিবী। (ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
লেখক: নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি), সাতক্ষীরা।