‘বঙ্গবন্ধুর ছবিকে যথাযথ মর্যাদায় প্রকাশ করা হয়নি’ এবং ‘ছবির বিকৃতি হয়েছে’ এমন অভিযোগে আদালতে দাঁড় করানো হয়েছে একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে। আত্মসমর্পণের পর আদালত প্রথমে জামিন নামঞ্জুর করেছেন, এরপর একই আদালত আবার খাস কামরায় বসে জামিন আবেদনে সাক্ষর করেছেন। মামলা দায়েরকারী ব্যক্তিটি জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সরকারি দল আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ ওবায়েদুল্লাহ সাজু। এতখানি জানা গিয়েছিল প্রথমে। প্রাথমিক তথ্যে সচেতন মানুষজন তাদের ক্ষোভ, প্রতিবাদ প্রকাশ করেছে; হয়রানির প্রতিবাদ করেছে। এবং এ প্রতিবাদ পৌঁছেছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়েও। সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ‘বিস্ময়’ প্রকাশ করেছেন, ক্ষোভ সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাতেও। একজন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে করা মামলাকে আমলে নিতে বিধি অনুযায়ী প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়নি বলেও অভিযোগ ওঠে। প্রাথমিক তথ্য-প্রাপ্তির পর সকলের ক্ষোভ ছিল মামলা দায়েরকারী ওবায়েদুল্লাহ সাজুর বিরুদ্ধে, এবং এটাই স্বাভাবিক ছিল। পরবর্তীতে একে একে উঠে আসে ভয়াবহ চিত্র। পরিষ্কার হয়ে যায় এ হয়রানির নেপথ্যে ছিল দীর্ঘ প্রক্রিয়া, এবং সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার তৎকালীন এবং বর্তমান বরগুনা সদরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গাজী তারিক সালমনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। দৃশ্যপটে এক আওয়ামী লীগ ও আইনজীবী নেতা আসলেও নেপথ্যে ছিল অনেকেই। তার বিরুদ্ধে কেন এত ক্ষোভ তারিক সালমনের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে কিছুটা আন্দাজ করা হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ‘আমি আট মাস বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলায় কর্মরত ছিলাম। এসময় আমাকে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ যাতে সঠিকভাবে যথাযথভাবে সম্পন্ন হয় সেজন্যে আমি তৎপর ছিলাম। কঠোর অবস্থানে ছিলাম। আমি সেখানকার আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করি। আমি অবৈধ স্থাপনা করতে দেইনি আমি যতদিন সেখানে ছিলাম। এসব কারণে সেখানকার প্রভাবশালীরা আমার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ছিল। আমার অনুমান, তারা আমাকে হয়রানি করার জন্য বাদীকে দিয়ে এই মামলাটি করিয়েছে।’ তারিক সালমনকে আগৈলঝাড়া থেকে বরগুনা সদরে বদলি করা হয়েছিল। বিক্ষুব্ধ স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের কারণে তাকে যে বদলি করা হয়েছিল সেটা ভালোভাবেই অনুমান করা যায়। বদলির পর জুনের ৪ তারিখে স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত সবকটি পত্রিকার রিপোর্টের ভাষা ছিল একই রকম। শিরোনামটি ছিল ‘বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতকারী সেই ইউএনও অবশেষে বদলি’। এ খবরের প্রতিবাদ তিনি সকল পত্রিকায় পাঠালেও তারা সেটা প্রকাশ করেনি বলে জানিয়েছেন ইউএনও তারিক সালমন। হয়রানির দীর্ঘ প্রক্রিয়ার প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবসে শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় সেরা ছবিকে উপজেলা প্রশাসন ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের আমন্ত্রণ পত্র প্রকাশ করে, আর সেখান থেকেই অভিযোগ তোলা হয় ছবি যথাযথ মর্যাদায় প্রকাশ করা হয়নি এবং বিকৃতি হয়েছে। ৩ এপ্রিল বরিশালের জেলা প্রশাসক (ডিসি) গাজী মো. সাইফুজ্জামান ইউএনওকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেন, ইউএনও উত্তরও দেন। এই উত্তরকে আবার ‘সন্তোষজনক নয়’ বলে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের সচিবকে লিখিতভাবে জানান বরিশালের তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার মো. গাউস (বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা)। ওই চিঠিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়। দাপ্তরিক এ চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকেও। বিভাগীয় কমিশনারের এমন চিঠির পর ৪ জুন বরগুনা সদরে বদলি করা হয় ইউএনও গাজী তারিক সালমনকে। প্রশাসনিক সকল ব্যবস্থা গ্রহণের পর ৭ জুন মামলা করেন বরিশাল আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক (বর্তমানে সাময়িকভাবে বহিষ্কৃত) সৈয়দ ওবায়েদুল্লাহ সাজু। অভিযোগ আমলে নিয়ে চিফ মেট্রোপলিটন আদালতের বিচারক আলী হোসাইন ২৭ জুলাইয়ের মধ্যে আত্মসমর্পণের আদেশ দেন। এরপর ১৯ জুলাই ইউএনও আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করলেও প্রথমে জামিন না দিয়ে জেলহাজতে পাঠান বিচারক, এবং এর ঘণ্টাদু’য়েকের মধ্যে খাস কামরায় বসে জামিন দেন তিনি। এখানে উল্লেখের দরকার একজন ইউএনওর বিরুদ্ধে এত প্রশাসনিক কার্যপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হলো, শাস্তিমূলক বদলিও হলো কিন্তু সরকার সেটা জানত না তা অবিশ্বাস্যই ঠেকে। কারণ, ১৮ এপ্রিল মানে ৩ মাস আগে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগে কারণ দর্শানোর জবাবে বিভাগীয় কমিশনারের চিঠি গিয়েছিল; একই সঙ্গে অনুলিপি গিয়েছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়েও। শেখ হাসিনা ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মন্ত্রণালয়গুলো ৩ মাস আগে থেকেই জানত ইউএনওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, এবং ধারাবাহিকতা। অথচ কী আশ্চর্য তাদের মন্ত্রণালয়গুলো কোন ব্যবস্থা নেয়নি, ওটা আটকায়নি। উলটো ৪ জুন ইউএনওকে বদলি করে দেওয়া হয়েছিল। মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের সচিবকে চিঠি ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে অনুলিপি দেওয়া বিভাগীয় কমিশনারের সেই চিঠিটাকে স্রেফ চিঠি হিসেবেই দেখা সম্ভব হত যদি না ইউএনও-কে বদলি করা হতো। কোন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ ওঠার পর বদলিকে স্বাভাবিক বদলি হিসেবে দেখার সুযোগ নাই। ওটা নিশ্চিতভাবেই ছিল শাস্তিমূলক বদলি। ৪ জুন থেকে বরগুনা সদরে বদলি হন ইউএনও তারিক সালমন। এখানেও প্রশাসনিক প্রক্রিয়া আছে। আর অধীনস্থ মন্ত্রণালয়ে কী হচ্ছে না হচ্ছে এসব সম্পর্কে যদি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীগণ অবগত না থাকেন তাহলে প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতার এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কিছু হতে পারে না। এখন হয়ত অনেকেই বলতে চাইবে তারা এত ব্যস্ত সবকিছু দেখার সুযোগ কোথায়, কিন্তু ব্যস্ততা দায়িত্ব আর দায় এড়িয়ে যাওয়ার অজুহাত হতে পারে না। বসকেই তার অধীনস্থদের দায়িত্ব নিতেই হয়, আর এটাই স্বাভাবিক। এখানে যেমন আমরা একজন বিচারকের ভুল বিচারের জন্যে দায় দিচ্ছি প্রধান বিচারপতিকে, এটা যৌক্তিক; এবং একইভাবে ওই যৌক্তিকতার আওতায় কি মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীও পড়েন না? ইউএনও তারিক সালমনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পর ক্ষোভ প্রতিবাদ সকল কিছুই ছিল মামলাকারী আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে। প্রধানমন্ত্রীও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন এনিয়ে। প্রধানমন্ত্রীর বিস্ময় এবং দলীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পর বিস্ময়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে আছেন অনেকেই, অথচ বিস্ময় ত এত হেনস্থার পর হতে পারে না। কারণ মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ত সকল কিছুই জানার কথা। তার মন্ত্রণালয় যে সেটা জানে সে প্রমাণও আছে। তাহলে বিলম্বিত বিস্ময়ে বুঁদ হয়ে থাকার চাইতে সমন্বয়হীন প্রশাসনের পালে লাগাম টানার দাবি জানানো জরুরি। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ কিংবা লীগ নামধারী কেউ কিছু করলেই দলের উচ্চ পর্যায় থেকে ‘হাইব্রিড’, ‘কাউয়া’, ‘নব্যলীগার’, ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে কতক শব্দ ভেসে আসে। এটা যে দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা সেও প্রমাণিত। কারণ এ শব্দগুলো যাদের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়ে চলেছে সে তাদেরকেই উচ্চস্থান দিয়েছে খোদ আওয়ামী লীগ। দল, সংসদ ও সরকার সকল স্থানেই দলবদলে আওয়ামী লীগে এসে তরী ভেড়ানো অনেকেই আছে। সেক্ষেত্রে অনুপ্রবেশকারী, হাইব্রিড শব্দপ্রয়োগ যে স্রেফ তামাশা এক- সে বলার অপেক্ষা রাখে না। শেষ পর্যন্ত তারিক সালমনের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক এ মামলা প্রত্যাহার হয়েছে, এটা ইতিবাচক খবর। হয়রানির এ সময়ে দেশের বেশিরভাগ লোকই প্রতিবাদ করেছে। কিছু লোক আবার প্রধানমন্ত্রীর বিস্ময়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছে, তাদের কাছে হয়রানির চাইতে দলপ্রধানের বিস্ময়ের মূল্য ছিল বেশি। এই প্রতিবাদ আর স্তুতিবাক্যের আড়ালে পড়ে গেছে প্রশাসনের সমন্বয়হীনতার করুণ চিত্র। এক তারিক সালমন না হয় শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেয়েছেন, কিন্তু অন্য সালমনদের রক্ষাকল্পে রাষ্ট্র-সরকার কতখানি সক্ষম ও সচেতন সে নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেছে। সমস্যার মূলে হাত দিন। সমাধান করতে না পারলে অনেকভাবেই অন্য তারিক সালমনেরা ক্ষতিগ্রস্ত হতেই থাকবে। সময় যখন প্রতিবাদ, আবেগপ্রকাশ, টেলিফোন, দুঃখপ্রকাশের পালায় আবর্তিত; তখন প্রশাসনের সমন্বয়হীনতার করুণ চিত্র অপ্রকাশিত থেকে যাচ্ছে স্তুতিবাক্যের আড়ালে! অথচ এ আলোচনাটা জোরালো হয়ে ওঠার দরকার ছিল।