জাতীয়

ইউএনও সালমনকে হাজতে পাঠানোর আদেশদাতা দুর্নীতিবাজ বিচারককে প্রত্যাহারে সুপারিশ

By Daily Satkhira

July 25, 2017

অপ্রতিম রহমান : ইউএনও গাজী তারিক সালমনকে হেনস্তার ঘটনায় এবার বরিশালের সেই দুর্নীতিবাজ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আলী হোসেনকে প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে। নিয়মানুযায়ী আইনমন্ত্রণালয় এই সুপারিশ ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্টে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এর আগে গতকাল বরিশাল ও বরগুনা জেলা প্রশাসককে প্রত্যাহার করা হয়েছে একই ঘটনার জেরে।

উল্লেখ্য, দেশব্যাপী আলোচিত চলমান ঘটনা শিশুদের আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি দাওয়াতপত্রে ব্যবহার করায় আগৈলঝাড়ার সাবেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার গাজী তারিক সালমানের বিরুদ্ধে ৭ জুন ৫ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ চেয়ে মানহানি মামলা হয়েছিল। চিফ মেট্রোপলিটন আদালতে এই মামলাটিরবাদী হলেন জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ ওবায়েদ উল্লাহ সাজু। বর্তমানে বরগুনা সদর উপজেলায় কর্মরত ইউএনও গাজী তারিক সালমান ১৯ জুলাই আদালতে হাজির হলে তাকে জেলহাজতে প্রেরণ করেন। তবে এর দুঘণ্টা পর প্রশাসনের হস্তক্ষেপে জামিন মেলে।

ইউএনও গাজী তারিক সালমনকে জেলহাজতে পাঠানোর বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের কাছে বরিশাল মুখ্য মহানগর হাকিম মোহাম্মদ আলী হোসাইন যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার সঙ্গে বাস্তবতা ভিন্ন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

তবে এবিষয়ে তিনি সুপ্রিম কোর্টকে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন বলেও নিশ্চিত হয়েছে আইনমন্ত্রণালয়। এ সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণে দেখা গেছে, ওই দিন (১৯-৭-২০১৭) হাজতখানার আসামী গ্রহণের রেজিস্ট্রি খাতায় অন্য আসামীদের সঙ্গে গাজী তারিক সালমনের নামও ছিল। ওই রেজিস্ট্রারে তার নাম ছিল ১ নম্বর ক্রমিকে। শুধু তাই নয় সেখানে তারিক সালমনের পিতার নামের পাশাপাশি স্থায়ী ঠিকানাও উল্লেখ ছিল। পাশেই নির্দেশদাতার সূত্র হিসেবে লেখা রয়েছে ‘সিএমএম’ (চিফ মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট)। সিআর মামলা নং ৪২৭/১৭ (সদর) আসামী হিসেবে ইউএনও গাজী তারিক সালমন সেদিন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রোববার সুপ্রিম কোর্টের কাছে দেয়া লিখিত ব্যাখ্যায় বরিশাল মুখ্য মহানগর হাকিম মোহাম্মদ আলী হোসাইন বলেন, ইউএনও গাজী তারিক সালমনের জামিন নামঞ্জুরের কোন আদেশ ওইদিন তিনি দেননি। ব্যাখ্যায় তিনি আরো বলেন, ‘আদালতের কার্যপ্রণালী শেষে এজলাস ত্যাগ করে খাস কামরায় এসে শুনি ইউএনও-র জামিন নামঞ্জুর করে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে মর্মে অনলাইন মিডিয়ায় সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে তার জামিন আবেদন একটি বারের জন্যও নামঞ্জুর করা হয়নি। ফলে জেল হাজতে পাঠানোর কোন প্রশ্নই উঠে না।’ “ইউএনও-র পক্ষে নথি দাখিল হলে এবং উত্তেজনাকর পরিস্থিতির অবসান হলে জামিনের আবেদন এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ২০৫ ধারার আবেদন আইনানুগ প্রক্রিয়া পালনপূর্বক মঞ্জুর ক্রমে জামিন প্রদান করা হয়। ইউএনওর আদালত কক্ষ ত্যাগের পরে তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা যাতে বিঘিœত না হয় এবং অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি পরিহারের জন্যই আমি তৎক্ষণাৎ জামিনের দরখাস্তের আদেশ না দিয়ে নথি দাখিল হলে শুনানি শেষে আদেশ দেয়া হবে বলে উদ্ভূত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছি।” বিচারক তার ব্যাখ্যায় আরো বলেন, ‘(কোতোয়ালি) মামলাটি শুনানি চলাকালে উৎসুক জনসাধারণের রোষানল হতে ইউএনও-র ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য শুনানি মুলতুবি করা হয়। ইউএনওর আইনজীবী মোখলেছুর রহমানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কাগজাত (নথি) দাখিল করতে বলি এবং মৌখিক আদেশ দেয়া হয় যে, নথি দাখিলের পরে পুনরায় শুনানি হবে। আমি তখন ইউএনওকে আদালত কক্ষে বসাতে বলি। আদালতে কর্তব্য পালনরত পুলিশ সদস্যগণ ইউএনও-র সার্বিক ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিতে সাধ্যমত চেষ্টা করেন।’ “ইউএনওকে আদালতের কাঠগড়া হতে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা দিয়ে আদালতের কক্ষে বসানোর জন্য আদালত কক্ষের এক দরজা দিয়ে বের হয়ে বারান্দা ব্যবহার করে অন্য দরজা দিয়ে আদালত কক্ষে আনতে হয়েছে। এই সময়ে মিডিয়ার কর্মীরা বা অন্য কেউ কোন ছবি তুলেছেন কিনা তা অবলোকন করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই সময়ে কি সংবাদ প্রচার করা হয়েছে তাও আমি বিচারকার্য পরিচালনাধীন থাকায় তা জানতে পারিনি।”

কেবল সার্কিট হাউসে ভাড়া বকেয়া নয়, বিনা ভাড়ায় লঞ্চে যাতায়াতের কথা ফাঁস হয়েছে বরিশালের মুখ্য মহানগর হাকিম মো. আলী হোসাইনের বিরুদ্ধে। যাত্রী চাপ থাকায় ঈদুল ফিতরে পছন্দের বিনা ভাড়ার সিটের টিকেট দিতে বিলম্ব হওয়াতে গ্রীন লাইন ওয়াটারওয়েজের কর্মকর্তা মো. লিপটনকে পুলিশ দ্বারা ডাকিয়ে নেওয়া হয়েছিল। একথার সত্যতা স্বীকার করেন কোতোয়ালি মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আওলাদ হোসেন। বিচারকরা প্রভাব খাটিয়ে বিনা ভাড়ায় যাতায়াত করলে এটা নৈতিকতার পরিপন্থি বলে জানালেন নাগরিক সমাজের নেতৃস্থানীয়রা। গ্রীন লাইন ওয়াটারওয়েজের কর্মকর্তা মো. লিপটন বলেন, প্রায় আড়াই বছর আগে বরিশাল টু ঢাকা রুটে নদীপথে তাদের গ্রীন লাইনের যাত্রা শুরু হয়। এর মাস কয়েক পরই চিফ মেট্রেপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের পেশকার মো. সুমন হাওলাদার তাদের বিচারক মো. আলী হোসাইনের জন্য টিকেট নিতে আসেন। বিনা ভাড়ায় টিকেট চাইলে অপারগতা প্রকাশ করলে নানা ধরনের হয়রানির ভয় দেখায়। এরপর টিকেট দিতে রাজি হলেও তাও আবার সৌজন্য লেখা যাবে না বলে আপত্তি তোলেন পেশকার সুমন। অবশেষে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালে চাহিদা অনুযায়ী টিকেট দিতে বলেন। প্রতি বৃহস্পতিবার চিফ মেট্রেপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. আলী হোসাইন বরিশাল থেকে ৩টার লঞ্চে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। মাস ছয়েক হলো তার সাথে আরো যুক্ত হয়েছেন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক গোলাম ফারুকের জন্য বিনা ভাড়ায় টিকেট নেওয়া। এই দুই বিচারককে তাদের পছন্দের ছিট দিতে হয়। গ্রীন লাইন ওয়াটার ওয়েজের এই কর্মকর্তা আরো বলেন, এবার ঈদুল ফিতরে দুই বিচরকের পছন্দের সিট দিতে না পারায় বরিশাল কোতোয়ালি থানার পুলিশ তাকে ডেকে নিয়েছিলেন। অবশ্য পুলিশ বিষয়টি জানতে পেরে তার সাথে খারাপ কোন আচরণ করেননি। এনিয়ে কথা বলার জন্য চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক বা পেশকারকে মুঠোফোনে বার কয়েক কল দিলেও তারা রিভিস করেননি। তবে কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আওলাদ হোসেন বলেন, তাদের কাছে বলায় গ্রীন লাইনের কর্মকর্তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন মাত্র। অপরদিকে ২০১৫ সালে ২৭ অক্টোবর থেকে ২০১৬ সালের ২৮ জুন পর্যন্ত সার্কিট হাউজের ৭ নম্বর কক্ষে বাস করে মাত্র ৫ দিনে ৩৯০ টাকা ভাড়া প্রদান করেছেন চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মো. আলী হোসাইন। তার কাছে ৯৩ হাজার ৯৫০ টাকা পাওনা আছে বলে ৪ আগস্ট ২০১৬ তারিখ ওই সময়ের নেজারত ডেপুটি কালেক্টর কল্যাণ চৌধুরী চিঠি দিয়েছিলেন। সার্কিট হাউসের দায়িত্বে থাকা এনডিসি মোহাম্মদ নাহিদুল করিম বলেন, বকেয়া ভাড়া এখন পর্যন্ত পরিশোধ করেননি চিফ মেট্রেপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট। লঞ্চে বিনা ভাড়ায় টিকেট নেওয়া সার্কিট হাউসের ভাড়া পরিশোধ না করার বিষয়ে পাবলিক প্রসিকিউটর গিয়াস উদ্দিন কবুল বলেন, তিনি জানতেন লঞ্চে তাদের কোটায় থাকা সিটে ভাড়া পরিশোধ করে বিচারকরা যাতায়াত করেন। ভাড়া না দিয়ে যাতায়াত করে থাকলে এটা নৈতিকতা বিরোধী। এ নিয়ে সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট এসএম ইকবাল বলেন, বিচারকদের পরিচ্ছন্ন মনোভব থাকা আমাদের কাম্য। এ বিষয়গুলো সমাজের মানুষ জানতে পারলে তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা জন্ম নিবে এটাই স্বাভাবিক।

এ বিষয়ে ডেইলি সাতক্ষীরায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটি পড়ুন।