সাভারে প্রত্যাহারের পর বরিশালে বহিষ্কার অ্যাপিসোড। শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে সাময়িক বহিষ্কার বরগুনার ইউএনও তারিক সালমনকে হাজত খাটানো মামলার বাদী ওবায়দুল্লাহ সাজু। অস্বীকার, বহিষ্কার, প্রত্যাহারের এ বায়োস্কোপ সরকারকে-আওয়ামী লীগকে কোথায় নিয়ে ঠেকাচ্ছে দলটির হিতাকাঙ্ক্ষীদের তা মর্মবেদনায় ভোগাচ্ছে। স্বাধীনতা দিবসের আমন্ত্রণপত্রে এক শিশুর আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি ব্যবহার করার জের ধরে এই ইউএনওর বিরুদ্ধে মামলা, হাজতবাসের সার্কাস প্রশাসন, নাগরিক সমাজসহ গোটা দেশে তামাশাকর পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর বিরক্তি ও দলীয় অ্যাকশনেও কূল কি মিলেছে? তা পুনরুদ্ধারই বা কতটা সম্ভব? এর মাত্র দুই দিন আগে, ‘পাঁচজনকে ক্রসফায়ারে দিয়েছি, ১৪ জনের লিস্ট করেছি’—মর্মে দেওয়া বক্তব্য বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রত্যাহার করেছেন সাভারের মাননীয় ডা. এনামুর রহমান। পাশাপাশি বলেছেন, যথাযথভাবে উপস্থাপন না হওয়ায় তার বক্তব্যের রূপটি বিকৃত হয়ে ভিন্ন অর্থ হয়ে গেছে। এ জন্য তিনি দুঃখিত। এর আগে বিনা বিজ্ঞাপনে গর্বভরে বলেছেন, সাভারে এখন সব পানি হয়ে গেছে। সব ঠাণ্ডা। কারও টুঁ-শব্দ করার সাহস নেই। পাঁচজনকে ক্রসফায়ারে দিয়েছি। আরও ১৪ জনের লিস্ট করেছি। লিস্ট করার পর যে দু-একজন ছিল তারা তার পা ধরে বলেছে, জানে মাইরেন না। শুরুতে অস্বীকার। পরে বহিষ্কার। এর মাঝে এখন যোগ হলো প্রত্যাহার। এই সংস্কৃতি আর কোথায় গড়ানোর বাকি আছে? সংশোধনীমূলক বিজ্ঞাপনটিতে পাঠকদের বুঝতে সমস্যা হয়নি তিনি নিজে বিকৃত না তার বক্তব্য বিকৃত হয়েছে? সেই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, তার ক্ষমতা, পদ বা গদি কি প্রত্যাহার হয়েছে? বক্তব্য প্রত্যাহারে কি ক্রিয়াকর্ম প্রত্যাহার হলো আওয়ামী লীগে আচমকা আমদানিকৃত এই ডাক্তারের? লিস্ট করা ১৪ জনকে হয়তো প্রাণভিক্ষা দেবেন তিনি। কিন্তু ক্রসে খরচ করা পাঁচ প্রাণ কি ফিরিয়ে দিতে পারবেন? এ ছাড়া তিনি এসব কথা না বলে থাকলে প্রত্যাহারের কী আছে? কেনই বা দুঃখ প্রকাশ। নানা এনামে নৌকায় উঠে পড়া এই প্রজাতির মাননীয়দের নামে-বেনামে অপকর্মের তালিকা বেশ দীর্ঘ। অস্বীকার, বহিষ্কার, প্রত্যাহার নাটকে তারা এ যাত্রায় নিস্তারও নিচ্ছেন। মূল দায় চাপছে সরকারের ওপর। দল ও সরকারের শক্তির ওপর ভর করে বচনে বা কাণ্ড ঘটিয়ে নগদে বাহবা নেন মহাশয়রা। পরে গোলমাল বাধলে প্রথমে অস্বীকার। সাংবাদিকরা বিকৃত করেছে বলে দোষারোপ। এতেও ল্যাঠা না ছুটলে বক্তব্য প্রত্যাহার। দুঃখ প্রকাশ। এ দুটিই সহজ ব্যাপার। কিন্তু হত্যাসহ ঘটানো কিছু কাণ্ড তো প্রত্যাহারের সুযোগ থাকে না। পুষিয়ে দেওয়ার আওতায়ও থাকে না। এরপরও সার্কাসের মতো চলছেই খেলাটা। সাভারের মাননীয়ের বুক ফোলানো কথায় নগদে তিনি বেনিফিসিয়ারি। এলাকায় তার দাপট, হিম্মতের প্রচার বেড়েছে। একদিকে তার পক্ষের আতিপাতিরা জোর পেয়েছে। তারা সুর তুলে প্রচার করেছে লিডারের হেকমত। অন্যদিকে জানের ভয়ে দোয়াদরুদ পড়া বাড়িয়ে দিয়েছে প্রতিপক্ষের খুচরা কর্মী-সমর্থকরা। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মাস দুয়েক আগে অসাধারণ কিছু মন্তব্যে দেশ তোলপাড় করে দিয়েছিলেন। গণমাধ্যমে ব্যাপক কাভারেজ নেন। দলে হাইব্রিড, কাউয়া, ফার্মের মুরগা টাইপের কিছু মন্তব্যে চারদিকে বাহবা ছড়িয়ে পড়ে। আহা বেশ বেশ কোরাসের দু-তিন দিনের মাথায়ই কথা পাল্টে ফেলেন তিনি। প্রথমে বলেন, তিনি আসলে ঠিক এভাবে কথাগুলো বলেননি। সাংবাদিকদের উপস্থাপনের দোষে তার বক্তব্যের মানে বিকৃত হয়ে গেছে। পরে বলেন, তিনি বলেছেন ঠিকই। তবে, সিরিয়াসলি বলেননি। নেতা-কর্মীদের একটু রিফ্রেশমেন্ট দিতে ফান করে বলেছেন। মিটিংয়ে দীর্ঘ সময় বসে থাকতে থাকতে টায়ার্ড হয়ে যায় বলে তাদের একটু রিফ্রেশমেন্ট দিতে হয়।
সাংবাদিক বেচারারা এমনকি উপস্থিত নেতা-কর্মীরাও মন্ত্রীর কথাকে ফান মনে করেননি। সাংবাদিকরা গুরুত্বের সঙ্গে গণমাধ্যমে তুলে আনেন এ ধরনের কথামালা। আর পাঠক, দর্শক, শ্রোতা মিলিয়ে অডিয়েন্সের কাছেও তা মনে হয়েছে বেশ হট এবং হিট। তখন কে ভেবেছিল পরে তা অস্বীকার বা প্রত্যাহার করতে পারেন কোনো মহোদয়, মহাশয় বা মাননীয়? তবে, ইদানীং বেশ ভাবনার সঙ্গে সতর্কতাও যোগ হয়েছে গণমাধ্যম কর্মীদের। তাদের ফুটেজ, রেকর্ডসহ তথ্য-সাবুদ মজুদ রাখার প্রবণতা বেড়েছে। তাতে কী? মাননীয়রা তো আরও পাকা। জুতসই কৌশল হিসেবে তারা এখন সরাসরি অস্বীকারে না গিয়ে ধরেছেন প্রত্যাহার আর দুঃখ প্রকাশের পথ। পাকা কাজের সঙ্গে এরা কথায়ও পটু।
আসলে সমস্যা কথায় নয়, অন্য জায়গায়। দুর্দমনীয় ক্ষমতার সঙ্গে জবাবদিহিতা এবং লজ্জাহীনতা তাদের কেবল জয়ীই করছে। ক্ষমতার জৌলুসে মান্যবররা মন যা চায় তা-ই করতে পারছেন। কথা বলা তো আরও মামুলি। কোথাও থেকে তেমন বাধা আসে না। মানুষও ক্ষেপে না। বরং এ সার্কাস উপভোগ করে। ভয়ের সঙ্গে তোয়াজও করে। এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করে শুধু বেয়াকুবেরা। সাভারের এনাম ডাক্তার থেকে বিউটিকুইন শাবানা বা তার স্বামী বা স্বগোত্ররা তা বোঝেন বলেই তো বুদ্ধিমানের পালে। ঢাকার ডাক্তার ইকবালও বা বাদ পড়বেন কেন? মাননীয়ের পাইপলাইনে ঢুকতে পেরেছেন বলেই কক্সবাজারের বদি, টাঙ্গাইলের রানা, ঠাকুরগাঁওয়ে দবিরুল, ফেনীর নিজাম হাজারী বা পিনু খানদের লোভনীয় অগ্রগতি। এই মোহে পেশাজীবী থেকে নেশাজীবী, চিকিৎসাজীবী, সিনেমাজীবী সবার মধ্যে মাননীয়ের কাতারে শামিল হওয়ার লোভ দুর্নিবার পর্যায়ে। এই রেস পেশাজীবীদেরও নিচ্ছে পেশিজীবীতে। জনপ্রতিনিধি হতে না পারা দলীয় পদ-পদবিধারীরাও যে যেখান দিয়ে পারছেন হুকুমত কায়েম করে ছাড়ছেন। মাঝে-মধ্যে তাদের কাণ্ডকীর্তির ছিটেফোঁটা খবর গণমাধ্যমে লোকসমাজে সমালোচিত হলেও কদিন পর সব ঠিক হয়ে যায়। মায়ামন্ত্রী বা ঈশ্বরদীর ডিলু উজির ছাড়াও খেলার কোয়ার্টার মন্ত্রী আরিফ খান জয়, সিলেটের মাহমুদ সামাদ চৌধুরীদের ইতিহাস-ভূগোলের চ্যাপ্টারগুলো এই রেসলারদের মুখস্থ। মাননীয়দের স্বজনদের দাপটও তো লোভনীয়-মোহনীয়। ইয়াবা, মানব পাচারের মতো অভিযোগেও বদি অ্যান্ড ব্রাদার্সের পশম হেলেনি। এর আগে সংরক্ষিত মাননীয়া পিনু খানের সোনার সন্তান রনির রাজধানীর নিউ ইস্কাটনে যানজটে বিরক্ত হয়ে গুলি করে দুজনকে পাখির মতো হত্যা, টাঙ্গাইলে রানা মাননীয়ের পরিবারের সদস্যদের কাণ্ডকীর্তি, ঈশ্বরদীতে ডিলুর ছেলে এবং জামাতা, আরিফ খান জয়ের ভাই শুভ, ঠাকুরগাঁওয়ে দবিরুল ইসলামের ছেলে সুজন, সাতক্ষীরার রিফাত আমিনের ছেলে রুমন, ঢাকার সাবেক এমপি এইচ বি এম ইকবালের ভাতিজা ফারিজ রহমানদের ক্ষমতার বাহার হিরোইজমের মতো। এই থ্রিল-সাসপেন্সের ঘোড়ায় চড়তে ইচ্ছা কার না হয়? মান্যবরদের উল্টো পথে প্রটোকলে গাড়ি হাঁকানো, বিমানের শিডিউল পেছাতে পারার মতো সমাদর স্থল, জল, অন্তরীক্ষে আধিপত্যের দৃষ্টান্ত গোবেচারার জন্যও প্রেরণাদায়ক। বিভিন্ন এলাকায় মাননীয়দের স্বজনদের কদর-সমাদরও কম আকর্ষণীয় নয়। তা অনেকের ইমান-বিশ্বাসেও টোকা দিচ্ছে। তারা ভাবনমুনায় মনে করে বরাত বুঝি মাননীয় আর তাদের স্বজন-পরিজনদেরই। শবেবরাতে যত অর্জন-গর্জন, ভোগ- বরাদ্দ কি তাদের ভাগ্যেই লেখা হয়?
মারের ভয়ে মানুষকে চুপ রেখে আদাব-সালাম আদায় করা, ক্রসের লিস্টে ফেলা, জোড়া খুন থেকে সাত খুন, বশ্যতা মানলে ক্ষমা করে দেওয়ার মহানুভবতার এ সার্কাসে কখনো কখনো টুকটাক শব্দ হলেও শেষতক সমস্যা হয় না। নানা গুরুতর দুষ্কর্মেও পিছু হটতে হচ্ছে না তাদের। কোথাও বাপ-বেটা, ভাই-ভাতিজা এমনকি শালা-দুলাভাইয়ের দাপটের তাড়নার কটা খবর গণমাধ্যমে আসে? তাদের বেশির ভাগেরই মাইরের ওপর ওষুধ নাই— তরিকা যার যার এলাকায় বেশ লাগসই। মানুষের কাছে এরাই জয়ী। শক্তির পূজা সব বাজারেই চলে, তা জেনে বুঝেই তো সম্মানীয়দের এই অগ্রগতি। এই প্রতিযোগিতায় বাপের ব্যাটা, বাঘের বাচ্চা হওয়ার খায়েশ মিটিয়ে ছাড়ছে মহোদয় ও মাননীয়দের পুত্র-ভ্রাতারা। নিজেদের কর্মগুণে বাপ-ভাইয়ের নাম ভুলিয়ে নিজেদের সামনে নিয়ে আসছে। কলঙ্কিত হচ্ছে গোটা সরকার, দেশের প্রাচীন দল আওয়ামী লীগ। কখনো কখনো দায় পড়ছে খোদ প্রধানমন্ত্রীর ওপরও। অথচ অপকর্মের হোতা মাননীয়রা কোনো না কোনোভাবে নিস্তারই পেয়ে যাচ্ছেন। লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।