‘বিচার যখন পাইলাম না, আমরা মরতাম চাই, গাড়ির তলে পইরা মরমু না বিষ খাইয়া মরমু- আমরার নিচ্চতা (নিশ্চয়তা) নাই। ৪ শিশুরে মাইরা যখন তারা জাইরা (হজম) লাইছে, দুশনরে বাঁচাইয়া আন, আমরা ৪ শিশুর মা-রা মরতাম চাই, আমরা বাঁচতাম চাই না। শত্রু “অকলতে (শত্রুরা) কইছে, আমরারে কচুর মতো কাইট্যা ফালাইব। আমরা ২ বছর বিচারের লাগি অপেক্ষা কইরা কিতা পাইলাম। ৯ জনের মাঝে একটা মরছে, বাকী ৮টার ফাঁসি চাই। অয় তারারে ফাঁসি দেও, নাইলে আমরারে ফাঁসি দেও। বাহুবলে বহুল আলোচিত ৪ শিশু হত্যা মামলার রায় শুনার পর কান্নাজড়িত কণ্ঠে এ ভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করেন নিহত শিশু ইসমাঈলের মা মিনারা বেগম। একইভাবে একই প্রতিক্রিয়া নিহত অন্য ৩ শিশুর পরিবারের সদস্যদের। তাদেরও দাবি ‘৮ আসামীর ফাঁসি’। গতকাল বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোঃ মকবুল আহসান আলোচিত এ মামলার রায়ে ৩ জনের ফাঁসি, ২ জনের ৭ বছর করে কারাদন্ড এবং ৩ জনকে খালাসের আদেশ দেন।
ফিরে দেখা সুন্দ্রাটিকি ট্রাজেডি : গত বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি খেলার মাঠ থেকে ফেরার পথে নিখোঁজ হয় উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামের আব্দুল কাদিরের ছেলে ইসমাইল হোসেন (১০), আবদাল মিয়া তালুকদারের ছেলে মনির মিয়া (৭), ওয়াহিদ মিয়ার ছেলে জাকারিয়া আহমেদ শুভ (৮) ও আব্দুল আজিজের ছেলে তাজেল মিয়া (১০)। নিখোঁজের ৫দিন পর ১৭ ফেব্রুয়ারি গ্রামের নিকটবর্তী ইছাবিলের বালুর গর্ত থেকে মাটিচাপা অবস্থায় তাদের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘটনার পর নিহত মনির মিয়ার পিতা আবদাল মিয়া তালুকদার বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। মামলায় পুলিশ পঞ্চায়েত প্রধান আব্দুল আলী বাগাল, তার দুই ছেলে রুবেল মিয়া ও জুয়েল মিয়া, তার সেকেন্ড ইন কমান্ড আরজু মিয়া ও শাহেদ মিয়াকে গ্রেফতার করে। আব্দুল আলী বাগাল ছাড়া গ্রেফতারকৃত ৪জন আদালতে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দী প্রদান করে। ওই মামলার আসামী সিএনজি অটোরিকশা চালক বাচ্চু মিয়া র্যাবের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। পরে নিহত আসামী বাচ্চু মিয়ার ভাই উস্তার মিয়া ও বাবুল মিয়া এবং আব্দুল আলী বাগালের পুত্র বিল্লাল মিয়াকে পলাতক দেখিয়ে হবিগঞ্জ ডিবি’র তৎকালীন ওসি মুক্তাদির হোসেন মামলার চার্জসীট আদালতে প্রেরণ করেন।
সরেজমিন সুন্দ্রাটিকি : মামলার রায় ঘোষণার পর বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নিহত ৪ শিশুর বাড়ি গিয়ে দেখা যায় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। নিহতের পরিবারের সদস্যদের আত্মচিৎকারে এলাকার আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। কান্না জড়িত কণ্ঠে সকলের একই দাবি ৮ জনের ফাঁসি চাই। এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন নিহত শিশুদের দাদী মরমচান সহ তাদের মা। বেলা ২টার দিকে তাদের বাহুবল হাসপাতালে আনা হয়। অসুস্থদের মাঝে ইসমাইলের মা মিনারা (৪৫) ও দাদী মরমচান (৬০)কে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাজেলের’র মা চন্দ্র বানু (৪০), মনিরের মা সুলেমা (৪০) কে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
বাদী আবদাল মিয়ার প্রতিক্রিয়া : মামলার বাদী আবদাল মিয়া তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, যে রায় হইছে, এ রায়ে আমরা সন্তোষ্ট নায়। মেইন আসামী আব্দুল আলী অর্ডার দিয়া মারাইল, হে-ঐ (সে-ই) খালাস পাইলায়। তার পুলাইনত্যা মারল, তারা-রে দিল খালাস, দুইজনরে দিল কারাদন্ড। ৭ দিনও লাগত নায়, আব্দুল আলী তারারে লইয়া বারঅইয়া (বের হয়ে) আইব। আইয়া আবার আমরারে কাটব, আমরারে মারব। ৪টা বাইচ্চা মাইরা যদি আইত পারল, আমরা বুড়া মানুষরে মারলে কোন আর তারার সমস্যা হইবনি? ২/৪টারে মারবই। তিনি আরো বলেন, তারা (আসামীরা) জেল থাইক্যাও কইছে- ‘আমরা আইয়া লই তোমরারে কচুর মতো কাটমো। ৪টারে মারছি আরো ৮/১০টারে মারমো। তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, হে-রা মারতেই থাকবো আর আপনেরা খালি ছবি তোলতেই থাকবেন। তিনি আরো বলেন, আমি ৮ জনেরঐ ফাঁসি চাই। একজনতো মইরা (বন্দুক যুদ্ধে নিহত) গেছে। সবাইর ফাঁসি না হইলে এ বিচারে আমরা সন্তোষ্ট নায়। এই ছায়েদ স্বীকার কইরা বস্তা (লাশ গুমে ব্যবহারের বস্তা) বাইর কইরা দিছে। এই ছায়েদের ৭ বছরের কারাদন্ড হইছে। আর খালাস হইয়া গেছে মেইন আসামী আব্দুল আলী। তিনি বলেন, আব্দুল আলী মাডার এক/দুইটা করছেনি? সাবেক চেয়ারম্যানের ভাইরেও মাইরা ফাইছে। বাগানে এক মহিলারে বাইচ্যাসহ মাইরা ফালাইছে। তার কিছুই হইছে না। তিনি বলেন, কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলে না, সাক্ষী দেয় না। হক্কলেই ভয় পায়। সাক্ষীদের ডর দেখায়, মাইর-ধর করে। হারুন নামে আমরার এক সাক্ষীর টেং ভাইঙ্গা দিছে। তিনি বলেন, এ রায়ে আমরা সন্তোষ্ট নায়। আমরা উচ্চ আদালতে মামলা করবো।
মামলার রায় : সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মকবুল আহসান বুধবার দেড় বছর আগের এই চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে আসামিদের মধ্যে রুবেল মিয়া, আরজু মিয়া ও পলাতক উস্তার মিয়াকে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি দশ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। আর রুবেলের ভাই জুয়েল মিয়া ও শাহেদকে সাত বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা করেছেন বিচারক। হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় মামলার আসামী জুয়েল-রুবেলের বাবা আব্দুল আলী বাগাল এবং পলাতক আসামি বাবুল মিয়া ও বিল্লালকে আদালত খালাস দিয়েছে।
রায়ের পর গ্রামজুড়ে আতঙ্ক : এদিকে, সুন্দ্রটিকি গ্রামজুড়ে থম থমে অবস্থা বিরাজ করছে। সবার মাঝে একটা অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। কেউ টু শব্দটি করতেও রাজি হচ্ছেন না। গৃহিনী থেকে শুরু করে সুন্দ্রাটিকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র কেউ কোন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না। গতকাল বুধবার আদালতের রায়ের নির্ধারিত দিনে নিহত ৪ শিশুর পরিবারের কোন সদস্যই সিলেট দ্রুত বিচার আদালতে জাননি। এ ব্যাপারে বাদী আবদাল মিয়া বলেন, আসামীদের লোকজন দলবদ্ধ ভাবে আদালতে গেছে। আমরা ভয়ে আদালতে যাইনি। তিনি বলেন, আমরা গত ক’দিন ধরেই ভয়ে বাহিরে স্বাভাবিক চলাচল থেকে বিরত আছি। আমাদের সকলের মনেই আতঙ্ক বিরাজ করছে।
পুলিশ কর্মকর্তার ভাষ্য : এ ব্যাপারে সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (বাহুবল-নবীগঞ্জ সার্কেল) রাসেলুর রহমান বলেন, ৪ শিশু পরিবারের নিরাপত্তার জন্য সকাল থেকেই তাদের বাড়িতে ফোর্স মোতায়েন করে রেখেছি। যতক্ষণ পর্যন্ত বাদী পক্ষ নিরাপদ মনে করবে না ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা নিরাপত্তা দিয়ে যাব। তিনি আরো বলেন, ২ জন এসআই পদ মর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তার নেতৃত্বে ৮ কনস্টেবল মোতায়েন আছে। আমরা সব ধরণের পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত আছি।