পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার শুরু গত বছরের এপ্রিলে। এই সময় পানামা ভিত্তিক আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মোসাক ফনসেকা কর ফাঁকির এক কোটি ১৫ লাখ নথি প্রকাশ করে। নথিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনীতিক, তারকা, ব্যবসায়ী ও অপরাধীদের বিদেশে থাকা অবৈধ অর্থের ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়; যা বিশ্বজুড়ে পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি নামে পরিচিতি পায় খুব দ্রুত।
মোসাক ফনসেকার ফাঁস হওয়া অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করে। পানামার এই প্রতিষ্ঠান জানায়, গত ৪০ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্ষমতাসীন নেতা ও তাদের আত্মীয়-স্বজনরা অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত। এতে বিশ্বের প্রভাবশালী কয়েক ডজনেরও বেশি নেতা ও তাদের পরিবারের নাম উঠে আসে।
ব্যাপক আলোচিত পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি মামলায় শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী নওয়াজকে পদে থাকার অযোগ্য ঘোষণা করে রায় দেন আদালত। নওয়াজের জামাতা মুহাম্মদ সফদারকে জাতীয় পরিষদের সদস্য পদে ও অর্থমন্ত্রী ইসহাক দারকেও অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে
মোসাক ফনসেকার নথি বিশ্লেষণ করে ওয়াশিংটনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) জানায়, অর্থ পাচারে বিশ্বের শতাধিক রাষ্ট্রপ্রধান, ২০০ দেশের রাজনীতিক, খেলোয়াড়, চলচ্চিত্র তারকাসহ ২ লাখের বেশি মানুষ জড়িত।
বিশ্বজুড়ে শোরগোল ফেলানো এই নথিতে পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, তার তিন ছেলেমেয়ের নাম উঠে আসে। এরপরই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন পাকিস্তানের তৃতীয় মেয়াদে ২০১৩ সালে ক্ষমতায় আসা এই প্রধানমন্ত্রী।
দেশজুড়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনের মুখে পানামা পেপারস ইস্যুতে প্রথমবারের মতো গত বছরের ৫ এপ্রিল নওয়াজ শরিফ জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। অফশোর ফার্মে থাকা পরিবারের সদস্যদের অবৈধ অর্থের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে বিচারবিভাগীয় কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন তিনি।
আবারও ২২ এপ্রিল জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন পাকিস্তানের এই প্রধানমন্ত্রী। পানামা পেপারস কেলেঙ্কারির জেরে বাড়তে থাকা চাপের মুখে নওয়াজ শরিফ বলেন, ‘গোপন করার মতো কোনো কিছু নেই তার। একই সঙ্গে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুতে কোনো আপত্তি নেই বলেও জানান।’
তিনি বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে বিচারবিভাগীয় কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছি। যদিও আমি কোনো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নেই। গণতান্ত্রিক একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমি মনে করি, বিষয়টি পরিষ্কার করা আমার দায়িত্ব।’
নওয়াজ বলন, ‘তদন্তের জন্য আমি ও আমার পরিবারের সদস্যরা ঘোষণা দিয়েছি। আমি যদি দোষী সাব্যস্ত হই; তাহলে বাড়িতে ফিরে যাব।’
পানামা পেপারস কেলেঙ্কারির জেরে একই বছরের ১৬ মে নওয়াজ শরিফ তদন্ত কমিটি গঠনে পার্লামেন্টের প্রতি আহ্বান জানান। পার্লামেন্টে তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো কিছুর ভয় করি না এবং জবাবদিহীতার জন্য নিজেকে তুলে ধরেছি।’
‘পানামা পেপারস তদন্তের বিষয়ে আমি একটি সনদ তৈরির জন্য পার্লামেন্টকে আমার সঙ্গে অংশ নেয়ার অনুরোধ করছি; যা এর আগে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর সঙ্গে সাক্ষর করেছিলাম।’
এ সময় দেশটির ক্ষমতাসীন সরকার ও বিরোধী দল পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি তদন্তে কমিশন গঠনে সম্মত হয়। ওই বছরের ২০ অক্টোবর পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই), জামায়াত-ই-ইসলামি, জামহুরি ওয়াতান পার্টি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল নওয়াজ শরিফ ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে শুনানি অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন দায়ের করে।
তবে নওয়াজ শরিফ পরিবারের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ব্যাপারে দেশটির শীর্ষ আদালতের ধীরগতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে পিটিআই। নভেম্বরে ইসলামাবাদ অচল করতে আন্দোলনের চেষ্টা করে। এই সময় পিটিআইয়ের প্রতিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যায় নওয়াজ শরিফ নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান সরকার।
২৮ অক্টোবর পানামা পেপারস ইস্যুতে নওয়াজ শরিফ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও শুনানির জন্য পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেন দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। এর আগে নওয়াজকে ক্ষমতার অযোগ্য ঘোষণা করে রায় দিতে সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের বেঞ্চের কাছে পিটিশন দায়ের করে পিটিআই।
ওই বছরের নভেম্বরে দেশটির সুপ্রিম কোর্টে পাক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রথম শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে এপ্রিলে পাকিস্তানের আদালত নওয়াজকে ক্ষমতা থেকে সরাতে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ নেই বলে জানান। ওই সময় নওয়াজকে অপসারণের দাবির পক্ষে তথ্য সংগ্রহ করতে যৌথ তদন্ত দল (জেআইটি) গঠনের আদেশ দেন আদালত।
ব্যাপক আলোচিত পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি মামলায় শুক্রবার নওয়াজকে পদে থাকার অযোগ্য ঘোষণা করে রায় দেন। রায়ে নওয়াজের জামাতা মুহাম্মদ সফদারকে জাতীয় পরিষদের সদস্য পদে ও অর্থমন্ত্রী ইসহাক দারকেও অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে।
১৯৮৫ সালে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন নওয়াজ শরিফ। ১৯৯০ সালের ১ নভেম্বর প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানের মসনদে বসেন তিনি। তিন বছরের মাথায় ১৯৯৩ সালে দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করতে হয় তাকে।
১৯৯৭ সালে দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন নওয়াজ শরিফ। এবারও পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা হয়নি নওয়াজের। ১৯৯৯ সালে দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারান তিনি। তৃতীয়বারের মতো পূর্ণ মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারিতে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন নওয়াজ। এর ফলে ক্ষমতা পূর্ণ না করার হ্যাট্রিকও পূরণ হলো পাকিস্তানের এই প্রধানমন্ত্রী।