হাসান হাদী : সাতক্ষীরা সরকারি শিশু পরিবার। এতিম শিশুদের জন্য এটি হওয়ার কথা নিজ বাড়ির মত, নামেও তাই পরিবার শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু সাতক্ষীরার এই প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনার দায়িত্বে যারা আছেন তারা নিয়মিত সেখানে যান ফটোসেশন করতে, তারা কতটা শিশুবান্ধব তার অভিনয় করতে। তাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় এই প্রতিষ্ঠানটি দিনে দিনে একটি শিশু নির্যাতন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সাজানো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বড় বড় কর্তাব্যক্তিদের অতিথি করে সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রচারণার আড়ালে এই প্রতিষ্ঠানের বাতাস অসংখ্য এতিম শিশুর গুমরে গুমরে কান্না আর দুঃস্বপ্নে ভারি হয়ে উঠেছে। এখানকার পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত, তাদেরও রয়েছে সন্তান। কিন্তু শিশুদের প্রতি মমতা প্রদর্শনের যে নমুনা তারা দেখিয়েছেন তাতে শিউরে উঠছে সাতক্ষীরা জেলা তথা বাংলাদেশের অসংখ্য পিতামাতার বুক। বাস্তবতা হচ্ছে সাতক্ষীরা সরকারি শিশু পরিবারে দিনের পর দিন নির্যাতিত নিষ্পেষিত হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা। অকথ্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি কর্মচারীদের বিকৃত যৌনাকাঙ্খা পূরণেও শিশুদেরকে দাসের মত ব্যবহার করা হয়, ঠিকমত খেতে দেয়া হয় না, পরতে দেয়া হয় না, অসুস্থ হলে চিকিৎসা করানো হয় না।
সাতক্ষীরা সরকারি শিশু পরিবারের শিক্ষার্থীরা ভয়াবহ নির্যাতনের সংবাদ সাতক্ষীরার সর্বাধিক জনপ্রিয় অনলাইন নিউজপোর্টাল ডেইলি সাতক্ষীরা ও দৈনিক আজকের সাতক্ষীরায় প্রকাশিত হওয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এঘটনায় জেলা প্রশাসক সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছেন। এদিকে অভিযুক্তদের মধ্যে বিমল বৈরাগীকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে তার পূর্ববর্তী কর্মস্থলে স্থানান্তর করেছেন।
উল্লেখ্য, পুরাতন সাতক্ষীরা এলাকায় ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত সরকারি শিশু পরিবারে (এতিম খানা, বালক) এখন বাস করে ৬৮ জন এতিম শিশু। তাদের দেখভাল করার জন্য শিক্ষক কর্মচারীসহ ১৭টি পদের মধ্যে রয়েছে ৯ জন। শিশু শিক্ষার্থীদের অভিযোগ যৌন নির্যাতন, মারপিট, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা না রাখা, বিনোদন, আতœীয়ের দেখা সাক্ষাৎ করতে না দেওয়া, ঠিকমত খাদ্য ও চিকিৎসা না দেওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের উপর নির্যাতন করা হয়। এসব বিষয় নিয়ে অভিযোগ করাই ইতোমধ্যে রুবেল, সুজন, সাগর, মাসুম বিল্লাহদের মেয়াদ থাকার পরও নির্যাতন করে বের করে দেয় এবং এ বিষয়ে কাউকে কিছু না বলার জন্য শাসানো হয়। এছাড়া তাদের ওপর নেমে আসে আরও বেশি নির্যাতন। উক্ত চারজন কর্মচারী তাদের ওপর সুযোগ বুঝে বিভিন্ন সময়ে এ নির্যাতন চালায়। এর প্রতিবাদ জানিয়েও কোনো লাভ হয় না হওয়ায় তারা রোববার রাতে বিকৃত যৌন নির্যাতন চালানোয় শিক্ষার্থীরা চার অভিযুক্তদের গণপিটুনি দেয়। শিক্ষার্থী উজ্বল হোসেন, আবদুর রহিম, সাকিব, আহসান হাবিব, আজমল হোসেন, তইবুর রহমান, মুরশিদ আলী, ফারুক হোসেন, ইয়াসিন আলী জানায়, আমরা তাদের নিয়াতনের শিকার। আমরা সব শিক্ষকদের অপসারন চাই’। তারা এ সময় বিকৃত যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আনে শিশু পরিবারের কর্মচারি বিমান বৈরাগী, তানভির হোসেন, আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, কৌশিক ফারহানের বিরুদ্ধে। রোববার রাতে তাদেরকে গণপিটুনি দিয়েছে শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীরা আরো জানায়, অভিযোগ করলেই ভারপ্রাপ্ত অফিস সহকারী আব্দুল আলিম ও শিক্ষক মোস্তফা নুরুজ্জামান তাদের উল্টো মার দেয়। তারা আরো বলে, তারা পরিবারের সাথে ঝগড়া করে এসে তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন। তবে সেখানে ১০০ আসন থাকলেও বর্তমানে ৬৮ শিক্ষার্থী রয়েছে। এক সময় সেখানে ভর্তি হওয়ার লাইন পড়তো। অনেকের অভিযোগ কর্তৃপক্ষের নির্যাতনের কারণে শিক্ষার্থীরা পালিয়ে চলে যায়। আর বর্তমানেও কেউ সেখানে ভর্তি হতেই চাচ্ছে না। শিশু পরিবারের উপ-তত্ত্বাবধায়ক মো. মিজানুর রহমান জানান, আমি এখানে মাত্র তিনদিন যোগদান করেছি। শিশুদের অভিযোগ পেয়ে জেলা প্রশাসক সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন’।
জেলা সমাজ সেবা উপ-পরিচালক দেবাশীষ সরদার বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পরপরই কর্মচারি বিমান বৈরাগীকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অপরদিকে এঘটনায় দৈনিক আজকের সাতক্ষীরা পত্রিকায় সোমবার একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সংবাদ প্রকাশিত হলে টনক নড়ে যায় প্রশাসনসহ সকল দপ্তরে। দৈনিক আজকের সাতক্ষীরা টক অব দ্যা ডিস্ট্রিক্টে পরিণত হয়। এছাড়া সাতক্ষীরার সচেতন নাগরিকবৃন্দ ফুঁসে উঠে। অনেকে মনে করছেন এটি যেন শিশু নির্যাতনের কেন্দ্র। ক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ ইতিমধ্যে আজ মঙ্গলবার সকাল ১০.৩০টায় সাতক্ষীরা নিউ মার্কেটস্থ শহিদ আলাউদ্দীন চত্ত্বরে মুক্তিযোদ্ধা-জনতার ব্যানারে এক বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।