তাঁর নাম আলহাজ আহসান উদ্দিন শাহ। পাবনার ফরিদপুর উপজেলার বিএলবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা তিনি। তাঁর দাবি, তাঁর বয়স ১২৫ বছর!
গত ৩০ এপ্রিল মারা যান বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি ইন্দোনেশিয়ার সোদিমেদজো। তিনি ১৪৬ বছর বয়সে মারা যান। আহসান উদ্দিনের দাবি সত্যি হলে তিনিই বর্তমানে জীবিত ব্যক্তিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বয়স্ক।
বর্তমানে জীবিতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বয়স্ক হিসেবে গিনেস বুকে নাম লিখিয়েছেন ইসরায়েলের ইসরায়েল ক্রিস্টাল। তাঁর বর্তমান বয়স ১১৩ বছর।
বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছেন পাবনার আহসান উদ্দিন। তবে এখনো নিয়মিত নামাজ পড়েন। বহু আগে হজ করেছিলেন একবার। তিনি জানান, ওই সংক্রান্ত কাগজপত্রে তাঁর জন্মতারিখ দেওয়া ১৮৯২ সাল। তিনি জানান, ওই বছরে শীতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
আহসান উদ্দিন শাহের ছোট ছেলে সাংবাদিক গোলাম মওলা বলেন, ‘আমার বাবার দীর্ঘ জীবন পরিক্রমায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির আমুল পরিবর্তন যেমন দেখেছেন, তেমনি তিনটি শতক দেখা এই প্রবীণের জীবদ্দশায় ব্রিটিশ সরকার, পাকিস্তান সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের শাসন দেখেছেন। এই দীর্ঘজীবনের জন্য তিনি কৃতিত্ব দিয়েছেন নিয়ন্ত্রিত জীবন এবং খাদ্যাভাস। ছোট বেলা থেকেই তিনি নিয়মিত গরুর দুধ পান করেন। তাঁর প্রিয় খাবার দুধ কলা ভাত। তিনি এখনো নিজেই নিজের খাবার খেতে পারেন। এখনো তিনি গরুর দুধ ছাড়া ভাত খেতে চান না।’
বৃদ্ধ আহসান উদ্দিন শাহ ১৪ সন্তানের জনক। তাঁদের মধ্যে সাতজন ছেলে ও সাতজন মেয়ে। মুক্তিযুদ্ধের আগেই তাঁর প্রথম স্ত্রী মারা যান। ওই সময় ওই স্ত্রীর চার ছেলে, চার মেয়ে ছিল। পরে ১৯৬৯ সালে আবার বিয়ে করেন। স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত পাঁচ ছেলে ও চার মেয়েসহ মোট নয় সন্তান জন্ম দেন তাঁর দুই স্ত্রী। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তিনি আরো দুই ছেলে ও তিন মেয়েসহ মোট পাঁচ সন্তানের বাবা হন। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী এখনো বেঁচে আছেন।
সাংবাদিক গোলাম মওলা আরো বলেন, ‘আমার বয়স চল্লিশের কোঠায়। অথচ আশ্চর্যের বিষয় আমার জন্মের আগেই আমি দাদা ও নানা হয়েছি।’
গোলাম মওলা জানান, তাঁর বাবার সন্তানদের মধ্যে সবার বড় আয়েশা খাতুন। তাঁর বয়স ৯৫ বছর। এর পরই আছে আনোয়ারা খাতুন। তাঁর বয়স ৯০ বছর। আয়শা খাতুনের বড় ছেলে অর্থাৎ তাঁর বড় ভাগ্নে আশরাফ উদ্দিনের বয়স ৮০ বছরের কাছাকাছি। ইদানীং আহসান কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। চোখে একটু কম দেখছেন। কানেও তুলনামূলক কম শুনছেন।
আহসান উদ্দিন শাহ বলেন, ‘পাবনার ঈশ্বরদীর পাকশীতে যখন হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণ করা হয় তখন আমার বয়স ছিল ২২ থেকে ২৩ বছরেরও কাছাকাছি। ১৯০৮ সালের দিকে ব্রিটিশ শাসিত ভারত সরকার ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ তৈরির কাজ শুরু করে।’ তিনি জানান, ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ তৈরির সময় তিনি ও তাঁর বন্ধুরা সেখানে অনেক আড্ডা দিয়েছেন। রেল লাইনের জন্য যখন মাটি কাটা শুরু হয়, তখন তিনি তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে ওই রাস্তার ওপর ডাঙ্গুলি খেলেছেন। সেখানে গরু চড়িয়েছিলেন।
আহসান উদ্দিন আরো বলেন, ‘ওই সময় আমাদের চোখের সামনে নারী শ্রমিকরা জমি থেকে মাটি কেটে রাস্তা উঁচু করেছে। তারপর সেখান দিয়ে রেলপথ স্থাপন করা হয়েছে।’
নানা সূত্রে জানা গেছে, অবিভক্ত ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড ও উত্তর পূর্ববঙ্গের সঙ্গে কলকাতার সহজ যোগাযোগের কথা বিবেচনা করে ব্রিটিশ শাসিত ভারত সরকার ১৮৮৯ সালে এই অঞ্চলে রেলপথ তৈরির পরিকল্পনা করে। ১৯০৮ সালের দিকে তারা ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ তৈরির কাজ শুরু করে। ওই বছরই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণের মঞ্জুরি লাভ করে। এর পরের বছর ১৯০৯ সালে পদ্মায় পাকশী এলাকায় সেতু নির্মাণের জন্য সার্ভে করা হয়। ১৯১০-১১ সালে প্রথম কাজের মৌসুম শুরু হলে ভয়াল পদ্মার দুই তীরে সেতু রক্ষা বাঁধ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলে মূল সেতুর কাজ শুরু হয় পরের বছর ১৯১২ সালে। এর তিন বছর পর ১ জানুয়ারি ১৯১৫ সালে ১ ডাউন লাইন দিয়ে প্রথম চালু হয় মাল গাড়ি। দুই মাস পরই ৪ মার্চ ১৯১৫ সালে সেতুর ওপর ডাবল রেললাইন দিয়ে যাত্রীবাহী গাড়ি চলাচলের উদ্বোধন করেন তৎকালীন ভারতের গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয় লর্ড চার্লস হার্ডিঞ্জ, যার নামে বর্তমানে সেতুটির নামকরণ করা হয়।
আহসান উদ্দিন শাহ আরো বলেন, ওই ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ কলকাতা বন্দরে মাছ রপ্তানির জন্য প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে লাহিড়ী মোহনপুর, দিলপাশার, শরৎনগর ও বড়াল-ব্রিজ রেল স্টেশনগুলো চলনবিলের মাছ ও পাট রপ্তানির জন্য প্রসিদ্ধ ছিল।
এই বৃদ্ধের বয়স যখন ১০ বছর তখন তাঁর বাবা বরকত শাহ মারা যান। তৃতীয় সন্তান মো. আফজাল হোসেন শাহ মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে আহসান উদ্দিন বলেন, ‘শেখ সাহেবের ডাকে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখনই আমি আট সন্তানের বাপ। চার মেয়ে, চার ছেলে। এ ছাড়া ছোট বেলায় বাবা মারা যাওয়ায় সংসারের হাল ধরতে হয় আমাকেই।’ তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের সব ধরনের সহায়তা করেছি। তখন আমার তৃতীয় নম্বর সন্তান আফজাল হোসেন মুক্তিযুদ্ধে যায়। সে ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে আসে। ফিরে এসে ওরা সংঘবদ্ধভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়।’
বৃদ্ধ আলহাজ আহসান উদ্দিন শাহের ব্যাপারে ফরিদপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. খলিলুর রহমান সরকার বলেন, ‘আমরা যত দূর জানি বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ আমাদের ফরিদপুর উপজেলার বিএলবাড়ী গ্রামের আহসান উদ্দিন শাহ। তাঁর বয়স এখন ১২৫ বছর। তাই তাঁর নাম গিনেস বুকে তোলার দাবি জানাই।’