খুলনা

মুক্তি পেলেন সাংবাদিক লতিফ মোড়ল, ওসি প্রত্যাহার

By Daily Satkhira

August 02, 2017

একদিন কারাবাসের পর আজ বুধবার বিকেলে খুলনা জেলা কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন সাংবাদিক আবদুল লতিফ মোড়ল।

এদিকে সাংবাদিক লতিফ মোড়লের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা নিয়ে গ্রেপ্তারের ঘটনায় ডুমুরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুকুমার বিশ্বাসকে প্রত্যাহার করে জেলা পুলিশ লাইনে নেওয়া হয়েছে। মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনায় পুলিশ সুপারকে তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশের খুলনা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. দিদার আহমেদ।

আবদুল লতিফ মোড়ল খুলনা শহর থেকে প্রকাশিত দৈনিক প্রবাহের ডুমুরিয়া উপজেলা প্রতিনিধি। সেই সঙ্গে তিনি dalitvoice24.com-এর প্রতিনিধি। আর তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলার বাদী সুব্রত কুমার ফৌজদার যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক স্পন্দন-এর ডুমুরিয়া উপজেলা প্রতিনিধি।

সাংবাদিক ফৌজদার গত ৩১ জুলাই আবদুল লতিফ মোড়লের বিরুদ্ধে ডুমুরিয়া থানায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করেন। গভীর রাতে ডুমুরিয়া থানার পুলিশ লতিফের বাসায় গিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। পরের দিন আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠায়। আজ বুধবার ১০ হাজার টাকা জামিননামায় পুলিশ প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত খুলনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম নুসরাত জাবিন তাঁর অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেন। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে তিনি খুলনা কারাগারে থেকে মুক্তি পান। এই সময় তাঁর সহকর্মী, সন্তান ও শুভানুধ্যায়ীরা উপস্থিত ছিলেন। তাঁর গলায় ফুলের মালা পরানো হয়।

বাদী সুব্রতর সাংবাদিকতা নিয়ে প্রশ্ন: তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে দায়ের করা মামলার বাদী সুব্রত কুমার ফৌজদারের সাংবাদিকতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তিনি নিজের ফেসবুক আইডিতে যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক স্পন্দন পত্রিকার পাশাপাশি নিজেকে জাতীয় দৈনিক জনকণ্ঠের সাংবাদিক বলে পরিচয় দিয়েছেন। তবে দৈনিক জনকণ্ঠের খুলনা ব্যুরোপ্রধান অমল সাহা জানান, সুব্রত তাঁদের কোনো সাংবাদিক নন। ডুমুরিয়ায় তাঁদের কোনো প্রতিনিধি নেই। সুব্রতর ফেসবুক আইডিতে জনকণ্ঠের পরিচয় দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন।

এদিকে যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক স্পন্দন কর্তৃপক্ষ আরেক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আগ বাড়িয়ে ৫৭ ধারায় সুব্রত কুমার ফৌজদারের মামলা করার ঘটনায় বিব্রত। স্পন্দন পত্রিকার বার্তা সম্পাদক সিকদার খালিদ হোসেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা এ ঘটনায় বিব্রত হয়েছি। ডুমুরিয়া উপজেলা প্রতিনিধি সুব্রত কুমার ফৌজদারের বিরুদ্ধে আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে এগুতে চাই। তাঁকে প্রাথমিকভাবে শোকজ করব আমরা।’

কারণ হিসেবে সম্পাদক সিকদার খালিদ হোসেন বলেন, ‘দৈনিক স্পন্দনের নাম পদবি ব্যবহার করে পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে কেন তিনি এই গর্হিত কাজ করলেন সে জন্য তাঁকে তিনদিনের মধ্যে জবাব চেয়ে শোকজ করা হবে।’

এ ব্যাপারে আজ বিকেল থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সুব্রত কুমার ফৌজদারের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করলে তিনি কথা বলেননি। পরে খুদেবার্তা দিয়ে কল করলেও তিনি কথা বলেননি।

ডুমুরিয়ার ওসি প্রত্যাহার গত ৩০ জুলাই একটি অনলাইন গণমাধ্যম ‘প্রতিমন্ত্রীর সকালে দেওয়া ছাগল রাতে মৃত্যু’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশ করে। খবরে প্রতিমন্ত্রীর একটি ছবি ছিল। খবরে বলা হয়েছিল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ ২৯ জুলাই শনিবার সকালে ডুমুরিয়ায় দুঃস্থদের মাঝে ছাগল, হাঁস ও মুরগি বিতরণ করেন। তবে ওই দিন রাতেই একটি ছাগলের মৃত্যু হয়। অভিযোগ উঠেছে, রোগাক্রান্ত ছাগল হওয়ার কারণে মৃত্যু হয়েছে। এফসিডিআই প্রকল্পের আওতায় জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এ ছাগল, হাঁস ও মুরগি বিতরণ করে।

ওই খবরে স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দর বক্তব্য ছাপা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রাণিসম্পদ দপ্তরের কর্মকর্তাদের কঠোরভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সুস্থ ও সবল ছাগল, হাঁস, মুরগি ক্রয় করতে।’ ছাগল মারা যাওয়ার ঘটনা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।

ওই সংবাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শেয়ার করেন সাংবাদিক আবদুল লতিফ মোড়ল। আর শেয়ার করার সময় তিনি টাইমলাইনে লেখেন, ‘খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের দায়িত্বহীনতা…’।

অথচ মামলার বাদী সুব্রত কুমার ফৌজদার বিষয়টি না বুঝে তাঁর বিরুদ্ধে ডুমুরিয়া থানায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা ঠুকে দেন। এজাহারে তিনি বলেন, আসামি ইচ্ছেকৃতভাবে অসৎ উদ্দেশ্যে মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্য ‘প্রতিমন্ত্রীর সকালে দেওয়া ছাগল রাতে মৃত্যু’ শিরোনামের খবরে মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের ফাইল ছবি আসামির ফেসবুক আইডিতে আপলোড করেছে। আসামি আবদুল লতিফ মোড়ল মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের ফাইল ছবি সামাজিক ও ব্যক্তিগত মর্যাদা হানি করার লক্ষ্যে ইন্টারনেট/ওয়েবসাইট ও ফেসবুকে সরবরাহ করেছে।’

মামলার বাদী সাংবাদিক সুব্রত কুমার ফৌজদার এজাহারের সঙ্গে ‘প্রতিমন্ত্রীর সকালে দেয়া ছাগল রাতে মৃত্যু’ শিরোনামে সংবাদের প্রিন্টকপি ও ফেসবুকে শেয়ার করা আসামির পোস্টের স্ক্রিনশটের কপি যুক্ত করেন।

এজাহারে থাকা সংবাদের প্রিন্টকপিতে দেখা যায়, সংবাদে প্রতিমন্ত্রীর একটি পুরোনো ছবি দেওয়া আছে। একই ছবি সাংবাদিক আবদুল লতিফ মোড়লের ফেসবুক পেজে শেয়ার করা পোস্টেও আছে। অর্থাৎ তিনি নিজে থেকে প্রতিমন্ত্রীর কোনো ছবি যুক্ত করেননি।

মামলার বাদী এজাহারে সংশ্লিষ্ট সংবাদ ও ফেসবুকে শেয়ার করা আসামির পোস্টের স্ক্রিনশটের কপি যুক্ত করলেও ডুমুরিয়া থানার পুলিশ তা যাচাই-বাছাই বা প্রাথমিক তদন্ত না করেই এজাহার গ্রহণ করে এবং গভীর রাতে বাসায় গিয়ে সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করে।

সাংবাদিক আবদুল লতিফ মোড়লের মেয়ে মেহনাজ রেজা মিম্মা গতকাল বিবিসি বাংলাকে টেলিফোনে বলেন, ‘রাত আড়াইটার দিকে আমার আব্বুকে বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ ছিল, আমাদের ডুমুরিয়া থানার ওসি ছিল, আরো ২০ থেকে ৩০ জনের মতো মানুষ এসেছিল। দেয়াল টপকে তারা ঢোকে। তারা আমার রুমেও জোরে জোরে নক করে। আমি জানতে চাই ওনাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। তখন আমাকে বাজেভাবে বলা হয়, কোথায় নিয়ে যাচ্ছি সেটা আপনার মায়ের কাছ থেকে জেনে নিয়েন।’

মেহনাজ রেজা মিম্মা আজ বুধবার খুলনার আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের জানান, তাঁর বাবার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। তাঁর বাবার কোনো দোষ ছিল না। তিনি শুধু একটি নিউজ শেয়ার করেছিলেন।

মামলার বিষয়ে ডুমুরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুকুমার বিশ্বাস আজ প্রত্যাহারের আগে মুঠোফোনে জানান, ৩১ জুলাই মামলা করার দিন কয়েকজন সাংবাদিক দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত বসে ছিলেন। সে কারণে মামলা নিতে হয়েছে। তবে ওপরের কোনো চাপ ছিল না।

ওসি বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মিথ্যা মামলা দায়ের করলে বাদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান আছে। তাই বাদী সুব্রত ফৌজদার যদি ভুল বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে থাকেন, তাহলে আইনমতো বাদীর বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গ্রেপ্তারের সময় বাড়াবাড়ির বিষয়টি ওসি অস্বীকার করেছেন।

এদিকে শুধু ফেসবুকে সংবাদ শেয়ার করায় সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা এবং গ্রেপ্তার নিয়ে আজ বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর নড়েচড়ে বসে পুলিশ প্রশাসন।

আজ রাত সাড়ে ৮টার দিকে খুলনা জেলা পুলিশ সুপার নিজামউদ্দিন জানান, ডুমুরিয়া থানার ওসি সুকুমার বিশ্বাসকে থানা থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনে আনা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে কমিটি করা হবে। ডুমুরিয়ার ওসি হিসেবে পরিদর্শক (তদন্ত) আবদুল খালেককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে পুলিশের খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি মো. দিদার আহমেদ বলেন, ‘আমি খুলনার পুলিশ সুপারকে বলেছি, ডুমুরিয়ার ওসি সুকুমার বিশ্বাসের কর্মকাণ্ড তদন্ত করে দ্রুত প্রতিবেদন দিতে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’