মোজাফফর হোসেন কলারোয়া : এক দিন কলেজে যেতে না পারলে নিজেকে অপরাধী মনে হতো। প্রতিদিন কলেজে সহপাঠিদের সাথে আড্ডা দেয়া, কলেজে কোন শিক্ষার্থীদের সমস্যা হলে সেটা সবাই মিলে সমাধান করা, শিক্ষকদের সাথে ছাত্রদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আলোচনা করে সমাধানের চেষ্টা, নবাগত ছাত্র-ছাত্রীদের বরণ করে নেয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মিদের প্রতিনিয়ত মিছিল। পরে আবার একসাথে ক্যান্টিনে বসে চা খাওয়া, ছাত্র-ছাত্রীদের চিৎকার, কোলাহলরত অবস্থায় ঘুরে বেড়ানো আবার নিয়মিত শিক্ষকদের ক্লাস নেয়া, মনোযোগ সহকারে ক্লাসে স্যারের কথা শোনা এখন মনে হয় সবই যেন ইতিহাস, মনে হয় এসব ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখা কোন ঘটনা। আনমনা হয়ে কথা গুলো বলছিলেন, ৯০ এর দশকের কলেজ শিক্ষার্থী, ছাত্র নেতা ও কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ক্রিড়া সম্পাদক মোস্তাক আহমেদ। তিনি আরো বলেন, সে সময় কলেজে কয়েক শত ছাত্র-ছাত্রী সারাদিন কলেজ ক্যাম্পাসকে মাতিয়ে রাখতো। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোন সমস্যা হলে আমাদের (ছাত্র সংসদ) কাছে অভিযোগ করত। আমরা স্যারদের সাথে আলোচনা করে সে সব বিষয়ে সমাধান করতাম। ক্লাস শেষে ছাত্ররা কলেজ মাঠে ক্রিকেট খেলায় মেতে উঠতো। প্রতি বছর কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় যশোর বোর্ডের মধ্যে মেধা তালিকায় ১ম থেকে দশম স্থানের মধ্যে একজন হলেও স্থান করে নিত। জেলার বিভিন্ন উপজেলা এমন কি জেলা সদরের সরকারি কলেজে ভর্তি না হয়ে এই কলেজে লেখাপড়া করতে আসতো। শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য আবাসিক হল ছিলো। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে শিক্ষার্থী শূন্য হয়ে কলেজটি হারিয়ে যেতে বসেছে তার অতীত ঐতিহ্য। এখন দেখলে মনে হয় এখানে কেউ লেখা পড়া করতে আসে না। জন মানব শূন্য কলেজটি যেন মৃত্যুর দার প্রান্তে পৌছে গেছে। আজ কলেজের এ অবস্থার কারন কি ? উপজেলার সকল সচেতন মানুষের কাছে একই প্রশ্ন ! কলারোয়া সরকারি কলেজ এক সময়ে সাতক্ষীরা জেলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ হিসেবে খ্যাত ছিলো। সময়ের আবর্তনে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে তার যৌবনের উত্তাল দিনগুলি। কয়েক বছরের ব্যবধানে এ অবস্থার কারন কি ? নতুন অর্নাস কোর্স চালু হওয়ার পরও কলেজে আছে কয়েক শত শিক্ষার্থী, আছে প্রচন্ড শিক্ষক সংকট তবে নেই সেই রাজনৈতিক কোলাহল, নেই ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবক কলেজ ছাত্র সংসদ, নেই ছাত্র-ছাত্রীদের চিৎকার মাঠে খেলা করা, নেই কোন কোলাহল। বর্তমানে কলেজটি দুর থেকে দেখলে বোঝা যাবে না এখানে কোন শিক্ষার্থী আছে, বোঝা যাবে না এটা এক সময় জেলার দাপটে কলেজ ছিলো, নিরবে চলছে শিক্ষার্থীদের পাঠদান, চলছে কোন রকমে খুড়িয়ে খুড়িয়ে তাছাড়া পরীক্ষার ফলাফলের দিক থেকেও জেলার মধ্যে অনেক পিছিয়ে গেছে। যেন তার যৌবন হারিয়ে ফেলেছে। সরেজমিনে কলারোয়া সরকারি কলেজ ঘুরে জানাগেছে, এক সময়ে জেলার জন-মানুষের উচ্চ শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র কলারোয়া সরকারি কলেজে যেমন চলছে ছাত্র-ছাত্রী সংকট তেমনি প্রকট আকার ধারণ করেছে কলেজে শিক্ষক সংকট। বর্তমানে কলেজে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক না থাকায় শিক্ষা কার্যক্রমে চরম ব্যহত হচ্ছে তেমনি দক্ষ শিক্ষকের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে তার অতীত ঐতীহ্য। সাতক্ষীরা জেলার এক মাত্র উন্নত মানের মানুষ গড়ার কারিগর কলারোয়া সরকারি কলেজে সে সময় জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে নিন্ম এবং নিন্ম-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য জেলা শহরের কলেজ বাদ দিয়ে কলারোয়া সরকারি কলেজে ভর্তি হতো। ১৯৭৯ সালে উচ্চ শিক্ষিত সমাজ গঠনের লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় কলেজটি। অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে ১৯৮৫ সালের মধ্যে কলারোয়া সরকারি কলেজ ভালো ফলাফল অর্জন করায় ১৯৮৬ সালে তৎকালীন সরকার কলেজটিকে জাতীয় করন করেন। এর পর থেকে কলেজটি সাতক্ষীরা জেলায় একক আধ্যিপত্য বিস্তার করে ১৯৮৭ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত যশোর শিক্ষা বোর্ডে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে মেধা তালিকায় প্রথম স্থান, দ্বিতীয় স্থান থেকে দশম স্থানের মধ্যে একজন ছাত্র বা ছাত্রীর নাম থাকা যেন বাধ্যতামূলক হয়ে গিয়েছিলো। এর থেকে যেন কলেজটি দিকহারা হয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থী সংকট, শিক্ষক সংকটসহ নানা কারনে কলেজটি নির্জন স্থানে পরিনত হয়েছে। সর্বশেষ ২০০৪ সালে কলেজটিকে অর্নাস কোর্স (ব্যবস্থাপনা বিষয়ে) চালু করা হয়। সাতক্ষীরা-ঢাকা মহাসড়কের পাশে কয়েক একর জমির উপর দুইটি তিন তলা ও একটি দ্বিতল ভবন, কলেজের সামনে বিশাল খেলার মাঠ পাশে এক একর জমি নিয়ে একটি দীঘি, কলেজের সামনে ফুলের বাগান ও ক্যাম্পসের ভিতর এবং চারিদিকে বিভিন্ন ফলজ গাছের ছায়া বেশিষ্ঠত সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। রয়েছে ছাত্রদের দুই তলা আবাসিক ভবন। কলেজে খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, বর্তমানে কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক (ডিগ্রি) ও একটি বিষয়ে চালুকৃত অনার্স সব মিলিয়ে সহকারী অধ্যাপক এর পদ রয়েছে ৮টি বর্তমানে কর্মরত আছে ৭ জন, প্রভাষক পদ রয়েছে ১৯টি কর্মরত আছে মাত্র ৯ জন। এছাড়া অর্নাস শিক্ষার্থীদের জন্য মাত্র এক জন সহকারী অধ্যাপক রয়েছেন। বর্তমানে প্রাচীন ঐতীয্যবাহি কলেজটিতে অধ্যক্ষ, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক সব মিলিয়ে ১৮ জন শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন। অথচ কলেজে প্রভাষকের পদ খালী রয়েছে ১০টি এছাড়া সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপকের পদ খালি আছেই। খোজ নিয়ে আরো জানাগেছে, কলারোয়া সরকারি কলেজে কৃষিশিক্ষা বিষয়ের শিক্ষক গত তিন বছর যাবত শুন্য রয়েছে। এছাড়া কলেজে তিন বছর যাবত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেনীর ৮টি শুন্য পদে কোন নিয়োগ দেয়া হয়নি। কলারোয়া সরকারি কলেজ সূত্র জানায়, বর্তমানে কলেজে অধ্যায়নরত মোট ১ হাজার ৭শ’ ২৮জন শিক্ষার্থী রয়েছে অথচ শিক্ষক আছে অধ্যক্ষসহ মাত্র ১৮ জন। অথ্যাৎ ৬৪ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন করে শিক্ষক কর্মরত আছেন। কলেজের একাধিক অবিভাবক অভিযোগ করে বলেন, এক সময় কলারোয়া সরকারি কলেজে সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী অনান্য জেলা থেকেও ছাত্র-ছাত্রীরা লেখাপড়া করতে আসতো। কিন্তু এখন উপজেলায় কয়েকটি বে-সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়ে সরকারি কলেজের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে এবং সেখানে লেখাপড়ার মানও ভালো। তারা সরকারের উর্ধতন কর্তপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করে বলেন, কলারোয়া সরকারী কলেজটিতে সকল শুন্য পদে শিক্ষক নিয়োগ দেয়াসহ শিক্ষার্থীদের সমস্যার সমাধান করে সাতক্ষীরা জেলার গৌরব এই কলেজটিকে মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করে তার হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার জোর দাবি জানিয়েছেন। এ বিষয়ে একই দাবি করেছেন কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাও। কলারোয়া সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেনীর শিক্ষার্থী শিরিনি আক্তার, আকলিমা খাতুন, এম এ কাশেম ও অর্নাস ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী জাকির হোসেন, আরিফুল হক অভিন্ন সুরে বলেন, সাতক্ষীরা জেলার এক মাত্র ভালো ফলাফল অর্জন করা কলারোয়া সরকারি কলেজে লেখাপড়া করে ভালো ফলাফল অর্জন করবো সে কারনে এখানে ভর্তি হয়েছি। কিন্তু ভর্ত্তি হওয়ার পর অবাক হয়েছি। যে সু-নামের জন্য কলারোয়া কলেজে লেকাপড়া করার জন্য এসেছি সে কলেজটির মধ্যে এমন করুন অবস্থা সেটা আগে বুঝতে পারেনি। তারা আরো বলেন, যশোর শিক্ষা বোর্ডে কলারোয়া সরকারি কলেজের যে সুনাম আছে সেটি ধরে রাখতে না পারলে কয়েক বছরের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী কলেজটি শিক্ষার্থী শুন্য হয়ে পড়বে। বর্তমানে কলেজটি আর আগের মত নেই এমন উল্লেক করে জানান, তারপরও কলেজের সকল সংকট দুর করে ভালো শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনাতে পাররে জেলার এই শ্রেষ্ট বিদ্যাপিঠটি আবারো হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারবে। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষা মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ঠ উধর্ক্ষতন কতৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। এ বিষয়ে কলারোয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ বাসু দেব বসু কলেন, কলেজের বর্তমান অবস্থা এবং শিক্ষক সংকট সম্পর্কে সরকারের উধর্ক্ষতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে এবং জরুরি ভিত্তিতে শুন্য পদে শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার জন্য মন্ত্রলায়ে আবেদন জানানো হয়েছে। তিনি আরো বলেন, কলারোয়া সরকারি কলেজের ঐতিহ্য’র বিষয়ে আমি শুনেছি। আমি ও আমার সহকর্মিরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি কলেজটিকে আবারো আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনার। তিনি সকলের সহযোগিতা কামনা করে বলেন, কলারোয়া সরকারি কলেজটি শিক্ষক সংকট সমস্যা সমাধান হলে আবারো সাতক্ষীরা জেলার শ্রেষ্ঠ কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবো।