মুক্তামণির ডান হাত অক্ষত রেখেই সেখান থেকে প্রায় তিন কেজি ওজনের টিউমার অপসারণ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে। ইতোমধ্যে অস্ত্রোপচারের ধকলটা কিছুটা কাটিয়ে সুস্থ বোধ করছে মুক্তামণি। অস্ত্রোপচারের পর মুক্তামণির হাতটার ওজন যেন হঠাৎ করেই অনেক কমে গেছে।
১৩ আগস্ট মুক্তামণির বাবা ইব্রাহিম হোসেন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আল্লাহর রহমত, চিকিৎসকদের চেষ্টা আর কোটি কোটি মানুষের দোয়ায় মেয়ে আমার অনেক ভালো আছে। কাল অপারেশনের পর জ্ঞান ফিরেই কথা বলেছে।’
ইব্রাহিম হোসেন আরও জানান, মুক্তামণি তার কাছে বারবার জানতে চাইছে, ওর শারীরিক অবস্থা এখন কেমন। সে ভালো অাছে কি না।
মুক্তামণির বাবা জানান, সকালে মুক্তামণি স্যুপ খেয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন জানান, মুক্তামণি এখন অল্প অল্প করে স্বাভাবিক খাবার খাওয়া শুরু করতে পারবে।
১২ আগস্ট শনিবার সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে মুক্তামনিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের তৃতীয় তলার অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়। এরপর সকাল নয়টার দিকে তার ডান হাতে অস্ত্রোপচার শুরু হয়। অস্ত্রোপচার শেষে দুপুর পৌনে ১২টায় ব্রিফিং করেন চিকিৎসকেরা।
ব্রিফিংয়ে অস্ত্রোপচারের নেতৃত্বে থাকা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবুল কালাম জানান, মুক্তামনির ডান হাত অক্ষত রাখা হয়েছে। অস্ত্রোপচার প্রাথমিকভাবে সফল। তবে তাকে ঝুঁকিমুক্ত বলা যাবে না। কারণ তার ফুসফুসের সমস্যাসহ অন্যান্য জটিলতা রয়েছে। টিউমার শরীরের অনেক জায়গায় ছড়িয়েছিল।
তিনি বলেন, হাতের অংশটুকু বেশি খারাপ অবস্থায় ছিল। ওটা আজ অপসারণ করা হয়েছে। অপসারিত টিউমারটির ওজন প্রায় তিন কেজি। মুক্তামণির শরীর থেকে সব টিউমার সরাতে আরও পাঁচ থেকে ছয়টি অস্ত্রোপচার লাগবে। ওর শারীরিক অবস্থা বুঝে পরবর্তী অস্ত্রোপচারের সময় ঠিক করা হবে। দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণে রাখা হবে মুক্তামণিকে।
প্রসঙ্গত, সাতক্ষীরা সদর উপজেলার দক্ষিণ কামারবায়সা গ্রামের মুদি দোকানি ইব্রাহীম হোসেনের জমজ মেয়েদের একজন মুক্তামনি। তার জমজ হীরামনি সুস্থ থাকলেও দেড় বছর বয়স থেকে হাতে টিউমার শুরু হয় মুক্তামনির। সাতক্ষীরা, খুলনাসহ বিভিন্নস্থানে চিকিৎসা করালেও সুস্থ হয়নি সে। পরে অর্থাভাবে চিকিৎসা বন্ধ হয়ে গেলে ফুলে যাওয়া হাতটি গাছের বাকলের (ছাল) মতো হয়ে যায় এবং দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করে।
গণমাধ্যমে তার খবর প্রকাশ হলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তার চিকিৎসার দায়িত্ব নেয় সরকার। ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের অধীনে। ইতোমধ্যে তার চিকিৎসার বিষয়ে সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদের মতামত নেওয়া হলে তারা এই অসুখ নিরাময়যোগ্য নয় বলে মত দেয়। বাংলাদেশের চিকিৎসকরা তার বিষয়ে আশা না ছেড়ে শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
সে অনুযায়ী তার বায়োপসি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। ০৫ আগস্ট সকাল আটটা থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের মেডিকেল বোর্ড মুক্তামনির অস্ত্রোপচার শুরু করে। প্রথম অস্ত্রোপচার শেষে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ)তে রাখা হয়।
০৮ আগস্ট সকালে মুক্তামনির বায়োপসির রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পরে বেলা ১১টার পরে সাংবাদিকদের মুক্তামনির চিকিৎসা গঠিত ঢামেক বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন জানান, বায়োপসি রিপোর্টে প্রাথমিকভাবে দেখা গেছে, মুক্তামণির রক্তনালিতে টিউমার দেখা দিয়েছে। এই রোগটার নাম ‘হেমানজিওমা’। বায়োপসির প্রতিবেদন নিয়ে মেডিকেল বোর্ড বসে শনিবার সকাল ৮টায় মুক্তামনির হাতে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, হেমানজিওমা হলো শিশুদের রক্তনালীর মধ্যে টিউমার যেগুলোতে ক্যান্সার থাকে না। এই টিউমার শিশুদের মধ্যে প্রায়ই দেখা যায়। ত্বকের উপরিভাগে লাল গুটির মতো দেখতে এই টিউমার একটা সময়ের পর বিনা চিকিৎসায় মিশে যায়। বেশিরভাগ শিশুরই এতে কোনো সমস্যা হয় না।
তবে ফেটে গিয়ে রক্ত বের হলে তা যন্ত্রণাদায়ক হয়। টিউমারের আকার ও অবস্থানের উপর নির্ভর করে এটা বিকৃতও হয়ে যেতে পারে। উপরন্তু এগুরো স্নায়তন্ত্র বা মেরুদণ্ডের সমস্যাও তৈরি করতে পারে। ত্বক ছাড়াও যকৃত ও ফুসফুসের মতো আভ্যন্তরীণ অঙ্গেও হেমানজিওমা হতে পারে। এগুলোও সাধারণত সমস্যা করে না।