সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সব রাজনৈতিক দলের ঐক্যের ওপর দিয়েছেন গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা। একইসঙ্গে তারা দলগুলোর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথাও বলেছেন। তারা বলেন, কমিশনের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে—সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো অংশ না নিলে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। এ কারণে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক ঐক্য জরুরি। বর্তমান ইসি এখন মাত্র টেস্ট-প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। রাজনৈতিক দলের আস্থা অর্জনে তাদের আরও অনেক পথ যেতে হবে। বুধবার (১৬ আগস্ট) আগাওগাঁওস্থ নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়ে তারা এই আহ্বান জানান।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মতো গণমাধ্যমের শীর্ষ ব্যক্তিরাও নির্বাচনে সেনা মোতায়েন ও ‘না’ ভোট চালুর সুপারিশ করেছেন। দুই/একজন সরাসরি বিরোধিতা করলেও বেশিরভাগই জাতীয় নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের কথা বলেছেন। তবে কেউ কেউ এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কমিশনের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন।
বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল সাংবাদিকদের বলেন, ‘বেশিরভাগ ব্যক্তিই সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলেছেন। ইসিকে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন করতে হবে, যেন সবাই নির্বাচনে আসে।’ সেনাবাহিনী মোতায়েন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সার্বিকভাবে অনেকেই মনে করছেন, সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রয়োজন নেই। অনেকেই বলেছেন, অনেক দেশে সেনাবাহিনী সুষ্ঠূ নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। তাহলে আমাদের দেশে সমস্যা কিসের? তবে আমি বলেছি, এটি সিভিল প্রশাসনের বিষয়, সেনা মোতায়েন দরকার নেই। তবে তারা স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে থাকতে পারে।’
মনজুরুল আহসান বুলবুল আরও বলেন, ‘‘আলোচনায় ‘না’ ভোটের বিষয় এসেছে। অনেকে ‘না’ ভোট চালুর বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন। কেউ কেউ বিরোধিতাও করেছেন। একটি বিষয়ে আমরা সবাই একমত হয়েছি যে, নির্বাচনে গণমাধ্যমকে সম্পৃক্ত করতে হবে। আমরা সুনির্দিষ্টভাবে বলেছি, ইসি প্রার্থীদের হলফনামা প্রকাশ না করার সিদ্ধান্তের কথা বলেছে। কিন্তু আমরা প্রকাশ করার দাবি করেছি। গণমাধ্যম যদি হলফনামা পর্যালোচনা করতে পারে, তাহলে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রার্থীদের বিষয়ে একটি যাচাই করা যাবে। কেউ যেন সাংবাদিক বা পর্যবেক্ষক পরিচয় দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে না পারে, সেই বিষয়টিও ইসিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ বিষয়ে ইসিও আমাদের সঙ্গে একমত হয়েছে।’
মানবজমিনের সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘‘নির্বাচনে সেনাবাহিনী, ‘না’’ ভোট, সীমানা পুনঃনির্ধারণসহ বিভিন্ন ষিয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমি সেনাবাহিনী মোতায়েনের পক্ষে মত দিয়েছি। বলেছি, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করা হয়। আমরা কোনও বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা নই যে, আমাদের এখানে সেনা মোতায়েন করা যাবে না।’’
বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাবগুলো এসেছে, সেগুলো হলো—কিভাবে নির্বাচন সুষ্ঠু করা যায়। সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। একইসঙ্গে নির্বাচনে সেনাবাহিনী থাকবে কিনা, তা নিয়েও কথা হয়েছে। ইসি যদি মনে করে সেনাবাহিনীর দরকার, তাহলে মোতায়েন করবে, না চাইলে নয়। তবে, আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকাকে বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছি।’
এছাড়া জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করে কালো টাকার পথ নিয়ন্ত্রণের কথাও বলেন নঈম নিজাম। নির্বাচনি আসন পুনর্বিন্যাস সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘কিছু আসন পুনর্বিন্যাস করা দরকার।’
নির্বাচনে সেনা মোতায়েনে বিপক্ষে মত দিয়েছেন প্রেসক্লাবের সভাপতি শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে নয়, সেনা মোতায়েন হতে পারে একমাত্র জাতীয় বিপর্যয়কালে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট। ২০০১ সালের নির্বাচনে সেনাবাহিনী ছিল। সেনাবাহিনী থাকার পরও সেখানে দেখেছি নির্বাচনের পরপরই জামায়াত-শিবির ও বিএনপি সংখ্যালঘুদের ওপর হামলে পড়েছিল। কাজেই নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেভাবে জঙ্গি দমনে ভূমিকা রাখছে, তেমনি সুষ্ঠু নির্বাচনেও তারা যথেষ্ট। নির্বাচন কমিশনই এসব বিষয়ে ভূমিকা রাখবে। আমি কমিশনকে অযোগ্য মনে করি না।’
সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমুলক নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক ঐক্য জরুরি উল্লেখ করে ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, ‘আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলার চেষ্টা করেছি। সুষ্ঠু ও নিরেপক্ষ নির্বাচনের পূর্বশর্ত হলো—সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। এ জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্য খুবই জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জনে কমিশনকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। কারণ কমিশন এখন মাত্র টেস্ট প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। আস্থা অর্জনে তাদের আরও অনেক পথ যেতে হবে। নির্বাচনের প্রধান স্টেক হোল্ডার হলো রাজনৈতিক দল। তাদের সঙ্গে সংলাপ করাটা বেশি জরুরি। একজন সাংবাদিক হিসেবে দেখি, একটি নির্বাচন করতে হলে যে ধরনের পরিবেশ দরকার, সেটি এখনও তৈরি হয়নি। কমিশন আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এমন আচরণ করবে, যেন জনগণের আস্থা তৈরি হয়।’ সেনা মোতায়েন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আসল কথা হলো একটি সুষ্ঠু নির্বাচন। সে জন্য সেনাবাহিনী কেন, যেকোনও বাহিনী দরকার হলে মোতায়েন করতে হবে, সেটিই গুরুত্বপূর্ণ।’
সিনিয়র সম্পাদক মাহফুজউল্লাহ বলেন, ‘সংলাপে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই ধরনের নির্বাচন যেন ভবিষ্যতে না হয়, সে জন্য কমিশনকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। নির্বাচনের আগে মাঠ প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে নির্বাচনের আগের তিন বছরে মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেননি এমন কর্মকর্তাদের পদায়নের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সংলাপে অংশগ্রহণকারী দুই/একজন ছাড়া সবাই সেনাবাহিনী মোতায়েনের কথা বলেছেন।’
বিএফইউজে একাংশের মহাসচিব এম আবদুল্লাহ তার লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধান দুই দল—আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের পন্থা বের করতে হবে। দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে কেবল গ্রহণযোগ্য একটি জাতীয় নির্বাচন সম্ভব। নির্বাচনের আগে অবশ্যই চলতি সংসদ ভেঙে দিতে হবে। নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করতে হবে। পোলিং এজেন্ট ও ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ‘না’ ভোটের বিধান রাখতে হবে। নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহে সাংবাদিকদের ওপর কোনও বিধি-নিষেধ আরোপ করা যাবে না।’
প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলেছি। প্রত্যেক দল যেন ৩৩ শতাংশ নারীর নেতৃত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করে, সে বিষয়ে কমিশনকে পদক্ষেপ নিতে বলেছি। ভিন্ন কোনও নামে যেন জামায়াত নিবন্ধিত হতে না পারে, কমিশনকে তার জন্য সতর্ক থাকতে বলেছি।’
সিনিয়র সাংবাদিক আমানুল্লাহ কবীর তার প্রস্তাবনায় সেনা মোতায়েন ও নির্বাচনে লেভেং প্লেইয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার প্রস্তাব দেন। তিনি বিএনপির নাম উল্লেখ করে বলেন, ‘বর্তমানে ওই দলটির অনেক নেতার নামে মামলা রয়েছে। ওই মামলার সূত্র ধরে নির্বাচনের সময় তাদের যেন হয়রানির শিকার হতে না হয়, তার জন্য নির্বাচনকালে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাদের মামলার হয়রানি থেকে রেহাই দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’ তিনি সেনা মোতায়েনের পক্ষে মত দেন।
গণমাধ্যমের সঙ্গে দুই দিনব্যাপী সংলাপের প্রথম দিনে (বুধবার) প্রিন্ট মিডিয়ার সম্পাদক/প্রতিনিধি, সিনিয়র সাংবাদিক ও সাংবাদিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে ইসি। বুধবার সকাল সোয়া ১০টায় শুরু হয়ে বেলা দুটো পর্যন্ত সংলাপ চলে। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধান নির্বাচন কমিশন কে এম নূরুল হুদা। প্রথম দিন গণমাধ্যমের ৩৭জন প্রতিনিধিতে আমন্ত্রণ জানানো হলেও উপস্থিত ছিলেন ২৬জন। সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, সিনিয়র সাংবাদিক আবেদ খানসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক আমন্ত্রণ পেলেও সংলাপে অংশ নেননি।