অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় ডুবছে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ বিমান, রেলওয়ে, বিটিসিএল, ডাক বিভাগ, টেলিটক, বিআরটিসি, সরকারি হাসপাতাল, শিক্ষা খাত থেকে শুরু করে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশন, বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প সংস্থা (বিসিআইসি), স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) এখন সমস্যায় ভারাক্রান্ত প্রতিষ্ঠান। সরকার যায় সরকার আসে, কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা উন্নত হয় না। বরং দিনের পর দিন প্রতিষ্ঠানগুলো ভয়াবহভাবে পথে বসতে শুরু করেছে।
দেশে বেসরকারি উড়োজাহাজগুলো যখন ইতিবাচক অবস্থান তৈরি করছে, তখনই বিমানের অবস্থা বেহাল। ইউএস বাংলা, রিজেন্ট এয়ার, নভোএয়ার এখন দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও প্রশংসা অর্জন করছে। অন্যদিকে বিমান এখন ডানাভাঙা প্রতিষ্ঠান। নিজেদের অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি ও সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে অবহেলায় একের পর এক আন্তর্জাতিক রুট তারা গুটিয়ে নিচ্ছে। বিমানের সার্ভিস নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে যাত্রীদের মধ্যে। বিমান আজ পর্যন্ত রুটগুলোর সময়সীমাই ঠিক করতে পারেনি। গতকালও লন্ডন ফ্লাইট পাঁচ ঘণ্টা পর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আকাশে উড্ডয়ন করে। এভাবে নয়টার বিমান কয়টায় যাবে কেউ জানে না। অথচ সামান্য পরিকল্পনা নিলেই বিমানের এ চিত্র বদলানো সম্ভব। পুরনো বিমান লিজে এনে প্রতিষ্ঠানটিকে লোকসানি খাতে পরিণত করা হয়েছে। যে দামে বিমান লিজে আনা হয়েছে, একই দামে নতুনই কেনা সম্ভব। বিমান নিয়ে খামখেয়ালিপনা চলছেই। বিমানের মতোই রেলওয়ের অবস্থাও বেহাল। যেভাবে সামনের দিকে পথ চলার কথা, তা চলছে না। রেলকে পৃথক মন্ত্রণালয় করার পর এ খাতে সরকার গত পাঁঁচ বছর ধরে পৃথক বরাদ্দ দিচ্ছে। কিন্তু যেভাবে রেলের উন্নয়ন হওয়ার কথা, তা বাস্তবে হচ্ছে না। শুধু কাগজে-কলমে বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করেই দেখানো হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির উন্নয়নের চিত্র। বাস্তবে রেলে অনিয়মের শেষ নেই। রেলে জমি লিজ থেকে শুরু করে ঘাটে ঘাটে অভিযোগের শেষ নেই। তবে একটা জায়গায় রেলের উন্নতি ঘটেছে। আগে যেখানে ট্রেনের সময়সীমা সঠিক ছিল না, সেখানে গত দুই বছরে সময়সীমার দিক দিয়ে রেল অনেক এগিয়েছে। এখন অধিকাংশ ট্রেনই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চলাচল করছে। সরকারের আরেক প্রতিষ্ঠান বিটিসিএল। এই প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে অপার বিস্ময় বিভিন্ন মহলে। বেসরকারি ফোন কোম্পানিগুলো লাভ করলেও সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি দিনের পর দিন শুধুই লোকসান গুনছে। বেসরকারি সব মোবাইল অপারেটরের চেয়ে নেটওয়ার্কে কয়েক গুণ শক্তিশালী হচ্ছে টেলিটক। অথচ এটিই এখন দুর্বল প্রতিষ্ঠান। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে গেলেই টেলিটকের দুর্বলতা ফুটে ওঠে। অথচ সব জেলায়-উপজেলায় টেলিটকের নেটওয়ার্ক রয়েছে। একইভাবে লোকসান বাড়ছে বিটিসিএলে। বছর বছর এখন যেভাবে যাচ্ছে, একসময় প্রয়োজনীতা ফুরিয়ে যাবে বিটিসিএলের। অথচ ল্যান্ডফোনের ডিমান্ড এখনো গ্রাহকের মধ্যে ব্যাপক। দুর্নীতির কারণে প্রতিনিয়ত ডুবতে থাকা সরকারের বৃহৎ এই প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক-ক্ষমতা ছিল প্রায় ১৩ লাখ। কিন্তু দুর্নীতির কারণে গত কয়েক বছরে এই প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক কমতে কমতে অর্ধেকে নেমে এসেছে। গত বছরও এর গ্রাহকসংখ্যা ছিল সাত লাখের ওপরে। আর চলতি বছর সেটি ছয় লাখের কিছু বেশি। প্রতিদিনই গ্রাহকরা সারেন্ডার করছেন শুধু অনিয়ম, দুর্নীতি ও হয়রানির কারণে। স্বাস্থ্যসেবায় সরকারি হাসপাতালগুলোর অবস্থা খুবই করুণ। উন্নমানের সেবা না পাওয়া, হাসপাতালে রোগীদের সঙ্গে চিকিৎসক-কর্মচারীদের দুর্ব্যবহারের কারণে সরকারি হাসপাতালগুলোর প্রতি মানুষের অনাগ্রহ দিনে দিনে বাড়ছে। ঢাকার নামীদামি বেসরকারি হাসপাতালে ঢুকে পরিবেশ দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। চিকিৎসায় গলাকাটা দাম থাকলেও চকচকে-ঝকঝকে পরিবেশ রাখেন তারা। ঠিক এর বিপরীত চিত্র হচ্ছে সরকারি হাসপাতালের। নোংরা পরিবেশ, চিকিৎসায় অবহেলা, উন্নত মানের খাবার না দেওয়াসহ নানা অভিযোগ রয়েছে সরকারি হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ, পঙ্গু হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল, হূদরোগ, মিটফোর্ড, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজধানীর প্রায় সব কটি সরকারি হাসপাতালের অবস্থা এক। কাগজে-কলমে এসব হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীর অভাব নেই। অভাব শুধু চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে। রোগীরা সরকারি হাসপাতালে ছুটে গেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকতে হয় হাসপাতালের বারান্দায় বা মেঝেতে। চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়। ফলে ভোগান্তির শেষ নেই সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবা নিতে যাওয়া রোগীদের। সর্বোপরি হাসপাতালগুলোর ব্যবস্থাপনায় ত্রুটির শেষ নেই। চিকিৎসাসেবার বাইরে কেনাকাটা নিয়েও রয়েছে সরকারি হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ। দীর্ঘদিন ধরে এসব অভিযোগ থাকলেও এগুলোর বিরুদ্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের ব্যবস্থা নেওয়ার নজির খুব কমই দেখা যায়। একই অবস্থা বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের। এখানে চলছে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি। ফলে ডুবতে বসেছে সরকারের এই প্রতিষ্ঠানটিও। সর্বশেষ নিয়োগ নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। কোনো রকম নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে এবং চাকরিবিধি অমান্য করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ২৯ জন কর্মচারীকে। বিএসইসির একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এ নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। লোকসান গুনছে বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প সংস্থা (বিসিআইসি)। সংস্থাটির ১৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৯টিতে গত অর্থবছরে ৩৩৮ কোটি ৭৬ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। আর বাকি চারটি প্রতিষ্ঠানের লাভ হিসাব করলেও সব মিলিয়ে লোকসান প্রায় ৭৮ কোটি টাকা। অথচ এর আগের বছরও প্রতিষ্ঠানটি ৯৩ কোটি টাকা লাভ করেছিল। বিসিআইসির কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদের অদক্ষতা, গাফিলতি ও অনিয়ম-দুর্নীতির কারণেই ডুবতে বসেছে বিসিআইসি এবং এর অধীন ১৩টি প্রতিষ্ঠান। এর ফলে হতাশায় আছেন এখানকার আট হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। অভিযোগ উঠেছে, বিসিআইসি লোকসান করলেও অতিরিক্ত গাড়ি ব্যবহারসহ চেয়ারম্যান নানা ধরনের অনৈতিক সুবিধা নিচ্ছেন। বিসিআইসির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২১৭ কোটি টাকা লাভ করেছিল বিসিআইসি। কিন্তু ২০১৪ সালের ১২ অক্টোবর মোহাম্মদ ইকবাল যোগ দেওয়ার পরই দুর্নীতি, অনিয়ম ও একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে লাভ কমে নেমে আসে ৯৩ কোটি ৪৪ লাখে। আর পরের বছরই লোকসান হয় ৭৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ লোকসান আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা। দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের বিরুদ্ধেও। ফলে গ্রামীণ রাস্তাঘাটের উন্নয়নে সরকারের যে বরাদ্দ রয়েছে, সেগুলোর যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। এলজিইডির মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত কর্মকর্তারা ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশ করে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করার কারণে অধিকাংশ রাস্তাঘাটই দ্রুততম সময়ে নষ্ট হয়ে যায়। ডাক বিভাগে তো চিঠির সংখ্যা কমেই গেছে। মানুষ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসের প্রতি। সরকারের এই প্রতিষ্ঠান প্রতিবছরই লোকসান গুনছে। যদিও এটিকে টেনে তোলার জন্য নানামুখী চেষ্টা করছে সরকার। বিআরটিসির করুণ অবস্থা দেখা যায় রাস্তায় নামলেই। সরকার নগরবাসীর যাতায়াত সুবিধা নিশ্চিত করতে দফায় দফায় সরকারি অর্থায়নে বিআরটিসির অধীনে যানবাহন নামালেও সেগুলো কিছুদিন চলার পর মুখ থুবড়ে পড়ে। যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলেই ফেলে রাখা হয় বিআরটিসির কোটি কোটি টাকা মূল্যের গাড়ি। সেখান থেকে ধীরে ধীরে সেসব গাড়ির যন্ত্রাংশ খুলে বিক্রি করে বিআরটিসির একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী। ফলে লাভের মুখ আর দেখা হয় না এই প্রতিষ্ঠানটির। শিক্ষা খাতের দুর্নীতি-অনিয়মের কারণে অনেক প্রকল্পই সঠিকভাবে ও সঠিক সময়ে শেষ হয় না। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন দৈন্যদশা সম্পর্কে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবার মান কমার অন্যতম কারণ হচ্ছে অনিয়ম-দুর্নীতি এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে জবাবদিহির ভয় না থাকা। বিশেষ করে সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের বড় কর্তাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি বা স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠলে তা আমলে না নিয়ে বরং তাদের পুরস্কৃত করা হয়। এতে দুর্নীতিবাজরা আরও উৎসাহিত হয়। অথচ একই সঙ্গে বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থাকে সেবার মান বাড়িয়ে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্য। ফলে সেটা তারা করতেও পারে। কেননা বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম-দুর্নীতি করলে শাস্তির বিধান কঠোরভাবে মেনে চলা হয়, যা সরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে হয় না। ফলে যে কোনো ধরনের সরকারি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের সেবার মান বাড়াতে হলে সবার আগে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, যে কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবার মান বাড়াতে হলে সে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মকর্তাদের মধ্যে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। হাসপাতাল, ক্লিনিক, ব্যাংক-বিমার কর্মীদের কাজ করতে হবে সেবার মানসিকতা নিয়ে। যদি কারও বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠে, এর সঠিক তদন্ত হবে। কর্মীদের মধ্যে এই মানসিকতা সৃষ্টি করাতে হবে যে, ভালো কাজ করলে যেমন পুরস্কার পাওয়া যাবে, খারাপ কাজ করলে বা অনিয়ম-দুর্নীতি করলে বা দায়িত্বে অবহেলা করলে তিরস্কারের মুখোমুখি হতে হবে। এমনকি কঠোর শাস্তির বিধানগুলোকে কার্যকর করতে হবে। অন্যথায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবার মানের সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠান সব সময়ই হেরে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন।