ধর্মীয়গুরু ডেরা সচ্চা সৌদা-র প্রধান গুরমিত রাম রহিম সিংকে (৫০) শুক্রবার ধর্ষণে দোষী সাব্যস্ত করায় উত্তাল হয়ে উঠে ভারতের হরিয়ানা, পাঞ্জাব। দিল্লীসহ আরো কয়েকটি রাজ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। একাধারে ধর্মপ্রচারক, সমাজ সংস্কারক, গায়ক, সিনেমার নায়ক ও পরিচালক এই চমকপ্রদ ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলেছিলেন এক অন্ধকার জগত। সিবিআই বিচারকের সামনে ধর্ষণের অভিযোগ তোলা দুই নারী ভক্তের সাক্ষ্যে উঠে আসে সেই চিত্র। ধর্ষণকে সেই ডেরায় বলা হতো ‘ক্ষমালাভ’।
গুরমিত রাম রহিমকে দোষী সাব্যস্ত করার পরপরই হরিয়ানা ও পাঞ্জাবে রীতিমতো যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়। এতে নিহত হয় কমপক্ষে ৩০ জন। আহতের সংখ্যা কয়েকশ। ধীরে ধীরে অন্যান্য শহরেও এই সংঘর্ষ ছড়িয়ে পরে। এই পরিস্থিতিতে পঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, এই ক্ষয়ক্ষতির পুরো খরচ আদায় করতে হবে ডেরা সচ্চা সৌদার কাছ থেকে।
গুরমিত রাম রহিম সিং-এর পরিচয় শিখ, হিন্দু, মুসলিম সব ধর্মের চেতনার মিশেলে তৈরি হয়েছে গুরমিতের ধর্মীয় সম্প্রদায়। ডেরা সাচ্চা সৌদার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। শাহ মস্তানা নামের এক ধর্মগুরু এর পত্তন করেন। বর্তমান প্রধান গুরমিত সিং ১৯৯০ সালে সম্প্রদায়ের নেতৃত্বের ভার নেন।
হরিয়ানা-পাঞ্জাবে অন্তত ৫ লক্ষ সরাসরি ভক্ত আছে গুরমিত রাম রহিমের। তাদের দাবি, সারা বিশ্বে গুরু রাম রহিমের ছয় কোটি ভক্ত আছে।
গুরমিত রাম রহিম সিং তিনটি সিনেমা তৈরি করেছেন। এর একটি এমএসজি: মেসেঞ্জার অফ গড। হরিয়ানার সিরসায় তার ডেরা সাচ্চা সৌদা আশ্রমের প্রাঙ্গণে নিয়মিত বসে পপ কনসার্ট। সেখানে গান ডেরার প্রধান, গুরমিত রাম রহিম সিং নিজেই – তার তুমুল জনপ্রিয় ‘ইউ আর মাই লাভ চার্জারে’র মতো আরও অনেক গান!
যত অভিযোগ ধর্ষণ ছাড়াও দৈনিক ‘পুরা সচ’ (সম্পূর্ণ সত্য) এর সম্পাদক রামচন্দ্র ছত্রপতিকে হত্যা, বিচারককে হুমকি, শিখ সম্প্রদায়ের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে গুলি চালানো, প্রাক্তন ম্যানেজার ফকির চাঁদকে খুনের পর গুম, আশ্রমের ৪০০ সাধুকে নপুংসক (খোজা) করে দেওয়ার মতো অভিযোগ রয়েছে গুরমিতের এবং তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে।
ক্ষমালাভ মানে ধর্ষণ ২০০৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সময়ে সিবিআই-এর বিচারকের সামনে সাক্ষ্য দেন ধর্ষণের শিকার দুই নারী। তাদের সাক্ষ্যের অনুলিপির ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন করেছে টাইমস অব ইন্ডিয়া। তাদের বিস্তৃতি বিবরণে উঠে আসে, এই ‘ক্ষমতাধর বাবা’ কিভাবে তাদের এবং ডেরার অন্যান্য নারীদের গুফায় (আন্ডারগ্রাউন্ড চেম্বারে ধর্মগুরুর থাকার জায়গা) প্রায়ই ধর্ষণ করতো। গুরমিতের আন্ডারগ্রাউন্ড কোয়ার্টারগুলোতে শুধুমাত্র নারী অনুগামীদেরকেই গার্ড হিসেবে নিয়োগ করা হতো।
সেই বিবৃতিতে নারীরা বলেন, ধর্ষণের সময় গুরমিত তার প্রবল ক্ষমতা জাহিরের জন্য নিজেকে ‘ইশ্বর’ হিসেবেও অভিহিত করতো। নারী ভক্তরা নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় ধর্ষণকে ‘মাফি’ (ক্ষমালাভ) শব্দে উল্লেখ করতো।
সেই নারীরা জানান, আধ্মাতিক নেতা হিসেবে গুরমিতের মর্যাদা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের অন্ধ ভক্তির কারণেই নারীরা ডেরার থাকতো।
২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বিশেষ সিবিআই বিচারক এ কে ভার্মার সামনে হরিয়ানার ইয়ামুনানগরের একজন নারী বলেন, ১৯৯৯ সালের জুলাই মাস থেকে তার ভাইয়ের জন্য তিনি ডেরায় থাকতে শুরু করেন। পরে বোনের জন্য ন্যায়বিচার চাওয়ায় তার সেই ভাইকে হত্যা করা হয়।
সেই নারী ভক্ত জানান, অন্যান্য নারী ভক্তরা যখন তাকে জিজ্ঞেস করতো “পিতাজি কি তোমার ক্ষমা মঞ্জুর করেছে” প্রথম প্রথম তিনি তা বুঝতে পারতেন না। কিন্তু পরে যখন ১৯৯৯ সালের ২৮/২৯ আগস্ট তাকে গুফার ভেতরে ডেকে নিয়ে গুরমিত ধর্ষণ করে তখন তার কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হয়।
ডেরার অারেকজন সেবিকা ২০১০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্য দেন, ১৯৯৮ সালের জুনে তিনি ডেরায় যোগ দেন। গুরমিত তাকে নাজাম নাম দেন। সিরসার বাসিন্দা এই নারী তার অভিভাবকের জন্যই গরমিতের অনুসারী হন। ডেরায় তিনি পড়াতেন।
১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বরে যখন তিনি গুফা প্রহরায় ছিলেন ডেরা প্রধান তাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে যায় এবং ধর্ষণ করে। তাকে হুমকিও দেয়া হয় এই বিষয়ে কাউকে কিছু না বলতে।
গুরমিতের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ তুলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বেনামী চিঠি ২০০২ সালের মে মাসে ডেরা সাচ্চা সৌদার এক নারী ভক্ত গুরমিত রাম রহিমের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ তুলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বেনামী চিঠি পাঠান। তার একটি প্রতিলিপি পাঞ্জাব-হরিয়ানা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছেও পাঠান ওই নারী ভক্ত।
এর দুমাসের মধ্যেই ডেরা সাচ্চা সৌদার পরিচালন সমিতির এক সদস্য রণজিৎ সিং খুন হয়ে যান। পরিচালন সমিতির সদস্যরা সন্দেহ করতেন যে সিং-ই তার বোনকে দিয়ে ওই বেনামী চিঠি লিখিয়েছিলেন। তার বোন ওই আশ্রমের এক সাধিকা ছিলেন।
ওই চিঠির ভিত্তিতেই হাইকোর্ট সিবিআই কে তদন্তের নির্দেশ দেয়। এরপর ২০০৭ সালে এই ধর্মগুরুর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের শুনানি শুরু হয়। শুক্রবার গুরমিত রাম রহিম সিং-কে বিশেষ সিবিআই আদালত দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেন। সাজা ঘোষণা হবে ২৮ তারিখ। এতে অন্তত ৭ বছর জেল, এমনকী যাবজ্জীবনও হতে পারে গুরমিতের।
রোহতকের সুনারিয়া জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে গুরমিতকে।ডেরা সচ্চা সৌদা-র পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবে তারা।