খোলা মত

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রামায়ণের মহাকাব্যিক কাহিনী নয়/ ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকার’র বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে -রাজেশ পাল

By Daily Satkhira

October 06, 2016

ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে রামের লংকা জয়ের সাথে তুলনা করে বলেছেন, ‘আমরা কোনও দেশকে অধিগ্রহণ করতে চাই না। ভগবান রাম লঙ্কা জয় করে তা বিভীষণকে দিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও আমরা তাই করেছি। আমরা কারও ক্ষতি করতে চাই না। তবে কেউ আমাদের ক্ষতি করতে চাইলে তার যোগ্য জবাব দেওয়া হবে।’ পাকিস্তানের উদ্দেশে ভারতের ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ টানেন পারিকর। ভারতের উত্তরাখন্ড প্রদেশের পৌরি গাঢ়ওয়াল এলাকায় একটি অনুষ্ঠানে শনিবার (২/৯/২০১৬) প্রতিরক্ষামন্ত্রী পারিকার এমন মন্তব্য করেন। ভারতের বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে তার এই বক্তব্যকে উদ্ধৃত করা হয়। রামায়ণের কাহিনী অনুসারে লংকারাজ রাবণ যখন রামের পত্নী সীতাকে অপহরণ করেন, তখন রাম ও লক্ষণ বানর সেনার সহায়তায় (বানর বলতে গাছের বানর নয় , এটি ছিলো একটি টোটেম বা গোত্রীয় প্রতীক) সীতাকে উদ্ধার করেন এক ভয়াবহ যুদ্ধের মাধ্যমে। বিভীষণ রাবণের ভাই হওয়া সত্ত্বেও সেই যুদ্ধে ভ্রাতার অন্যায়ের প্রতিবাদ স্বরূপ রামের পক্ষাবলম্বন করেন। যদিও এই ব্যাপারে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। অনেক ঐতিহাসিকের মতেই, বিভীষণের ভূমিকা ছিলো স্রেফ মীরজাফরের মতো। ন্যায় অন্যায়ের বিবেকবোধ থেকে নয়, বরং রাজ সিংহাসনের লোভেই বিভীষণ এই কাজটি করেছিলেন। এই বিভীষণের চক্রান্তেই লক্ষণের হাতে রাবণের বীরপুত্র ইন্দ্রজিত নিহত হন। এই কারণে ইতিহাসে মীরজাফরের মতোই বিভীষণ নামটিও এক দেশদ্রোহী গাদ্দারের প্রতীক রূপেই ব্যবহৃত হয় অনেকের কাছেই। মিঃ পারিকার এর কথা অনুযায়ী, লংকা যুদ্ধের সাথে একাত্তরের তুলনা তাই মেলাতে পারলাম না। তার কথার সূত্র ধরেই যদি বলি, তাহলে বিভীষণ ছিলো বীর বাঙালীরাই। কারণ যুদ্ধ শেষে তারাই তাদের ক্ষমতা ফিরে পায়। কিন্তু বাঙালীরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের কোন কিছু হরণ করে আনেনি। যেমনটি লংকারাজ করেছিল সীতাকে অপহরণ করে। বরং পশ্চিমা হানাদাররাই উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল বাংলার মাটিতে। দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘটনা। বিভীষণ করেছিল রাজ্যের আর সিংহাসনের লোভে, আর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালীদের সংগ্রাম ছিলো ২৪ বছরের নির্যাতন আর অবিচারের বিরুদ্ধে মানুষের মুক্তির সংগ্রামের অমর কাব্যগাথা। এই জায়গায় বিভীষণের সাথে বাঙ্গালীদের তুলনা নেহাতই অনভিপ্রেত ও দুঃখজনকও বটে। এখানে যদি ভারতীয় বাহিনীর তুলনা দিতেই হয়, তবে তা দেয়া যেতে পারে একমাত্র সুগ্রীবের বানরসেনার সাথেই। কেননা রামায়ণের কাহিনী অনুযায়ী রাম ও লক্ষণকে আশ্রয় প্রদান ও সীতা উদ্ধারের লড়াইয়ে পূর্ণ সহযোগিতা দিয়েছিলো এই কিস্কিন্ধার অধিবাসীরা। ঠিক যেমনটি ভারত করেছিলো একাত্তরে। এদেশের মুক্তিসেনাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ প্রদান ও ১ কোটি শরণার্থীকে ৯ মাস আশ্রয় প্রদানের ক্ষেত্রে ভারতের অবদানও তাই ছিলো। কিন্তু সেখানেও আছে আরেক ঝামেলা। ভারতের সাথে পাকিস্তানের শত্রুতা সেই জন্মলগ্ন থেকেই। সেই কারণে “শত্রুর শত্রু বন্ধু” বিবেচনায় ভারত বাড়িয়ে দিয়েছিলো সাহায্যের হাত। কিন্তু রামায়ণের কোথাও এমন কোন তথ্য সন্নিবেশিত নেই যে লংকা ও কিস্কিন্ধার মধ্যে কোনরূপ পূর্বশত্রুতার রেশমাত্র ছিলো। বরংচ সুগ্রীবের অগ্রজ ভ্রাতা বালী ছিলেন রাবণের পরম মিত্র। বালীকে হত্যা করে রাম সুগ্রীবকে সিংহাসনে বসানোর প্রতিদান দিতেই সুগ্রীব তার বানরবাহিনীকে নিয়ে রামের সাহায্যার্থে লংকায় আক্রমণ চালিয়েছিলেন। কাজেই এদিকটাও মেলেনা। রামায়ণের কাহিনীর সাথে বরং বেশ কিছুটা মিল পাওয়া যায় হোমারের ইলিয়াডের। রামায়ণের যুদ্ধ হয়েছিলো সীতা হরণকে কেন্দ্র করে, আর ইলিয়াডের যুদ্ধ হয়েছিলো হেলেন অফ ট্রয়কে নিয়ে। যদিও সীতার ঘটনাটি ছিলো অপহরণ, আর হেলেনেরটি ছিলো স্বেচ্ছাগমন। সীতাকে উদ্ধার করতে ছুটে এসেছিলেন তার স্বামী রাজা রাম, আর অন্যদিকে হেলেনকে উদ্ধার করতে ছুটে এসেছিলেন তার স্বামী রাজা মেনিউলাস। রামায়ণে লঙ্কাপুরী ধ্বংস হওয়ার পরে সীতা ফিরে গিয়েছিলেন তার স্বামীর কাছে, অন্যদিকে ট্রয় ধ্বংসের পরে হেলেন ফিরে যান মেনিউলাসের কাছে। কি অসাধারণ মিল বাল্মীকি আর হোমারের এই দুই মহাকাব্যের মাঝে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তানীদের

মতো ভারতীয়রাও “পাক-ভারত যুদ্ধ” বলেই আখ্যা দিতে বেশী পছন্দ করে থাকেন। ভারতীয়দের এটা বলার কারণ যুদ্ধজয়ের কৃতিত্ব নিজেরাই একতরফাভাবে দাবি করা। আর পাকিস্তানীদের এটা দাবির কারণ তারা বাঙালীদের যে অস্পৃশ্য শুদ্র বলে বিবেচনা করতো, তাদের ভাষায় সেই “ইনফেরিয়র”দের হাতে পরাজয়ের চেয়ে শক্তিধর প্রতিপক্ষ ভারতের কাছে পরাজয়ের ইতিহাসটাই অনেকখানি সম্মানজনক বলে বিবেচনা করে তারা। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যে তারই প্রতিধ্বনি শোনা গেল মাত্র। এদেশের মুক্তি সংগ্রামে ভারতের অকুন্ঠ সহোযগিতার কথা অবশ্যই স্মরণ করি কৃতজ্ঞচিত্তে। সেই সাথে এটাও তাদের উপলব্ধি করা উচিৎ যে এদেশের মুক্তিযুদ্ধ কারো উপহার প্রদানের কাহিনীকাব্য নয়। এদেশের মুক্তিযুদ্ধ ৩০ লক্ষ বীর শহীদের আত্মবলিদানের ইতিহাস, এদেশের মুক্তিযুদ্ধ ২ লক্ষ বীরাঙ্গনার আর্তনাদের ইতিহাস, ক্র্যাক প্লাটুনের রুমি বদি আজাদদের ইতিহাস, চট্টগ্রামের কিংবদন্তী ক্যাপ্টেন করিমের ইতিহাস, ভাটির বীর জগতজ্যোতির দাস পার্টির ইতিহাস, কাদেরীয়া বাহিনী, হেমায়েত বাহিনীর ইতিহাস। বড় নির্মম, বড় গর্বের ইতিহাস। “আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দানে পাওয়া নয়, আমি দাম দিছি প্রাণ লক্ষ কোটি, জানা আছে জগতময়।”