জাতীয়

রয়টার্সের প্রতিবেদন: মিয়ানমার থেকে ৯০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে

By Daily Satkhira

September 04, 2017

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতন-হামলা আর ধর্ষণের মুখে রাখাইন রাজ্য থেকে বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে জীবন বাঁচিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা রোহিঙ্গা মুসলমানের সংখ্যা ৯০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

গত মাসের শেষ সপ্তাহে নতুন করে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতার পর যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশ উপকূলবর্তী কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্প ও আশপাশের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের দেখভালের দায়িত্বে থাকা জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিদের কাছ থেকে এ তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সীমান্তের নো-ম্যানস ল্যান্ডে এখনো হাজার হাজার রোহিঙ্গা খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায়।

মিয়ানমারে জাতিগত সহিংসতার শিকার হয়ে গত কয়েক দশকে বিভিন্ন সময়ে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, যাদের একটি বড় অংশ উপকূলের বিভিন্ন ক্যাম্পে নিবন্ধিত বা অনিবন্ধিত শরণার্থী হিসেবে অবস্থান করছেন। এদের মধ্যে অনেকে আবার কক্সবাজার, পার্বত্য তিন জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়েও পড়েছে।

এই বিপুল রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থানের মাঝেই গত বছরের অক্টোবরে আবার নতুন করে সহিংসতা দেখা দেয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে। তখন আরো প্রায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসে। এবার ২৫ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত সর্বশেষ ৯০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করল। অর্থাৎ গত ১১ মাসে বাংলাদেশে প্রায় পৌনে দুই লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে। প্রতি দিনই এ সংখ্যা বাড়ছে।

সীমান্তে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোরভাবে তৎপর রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। প্রতিদিনই নৌকায় বা সীমান্ত পথে আসা রোহিঙ্গা আটক করে পরে তাদের ফের নিজ দেশে পাঠাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশ প্রবেশ করার সময় নৌকা ডুবে এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা মারা গেছেন।

এদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলা-নির্যাতন ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকার মুখে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে সহিংসতার শিকার রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে জরুরি খাদ্য সরবরাহ কর্মসূচি স্থগিত করেছে জাতিসংঘ।

২০১২ সাল থেকে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহযোগিতা দিয়ে আসছিল জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। এতে আড়াই লাখ মানুষের খাদ্যের সংস্থান হতো। কিন্তু এ কর্মসূচি স্থগিত করায় তাদের খাদ্য নিরাপত্তায় চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হলো।

গত শনিবার ডব্লিউএফপির এক বিবৃতিতে বলা হয়, রাখাইন রাজ্যে সহিংসতায় অভ্যন্তরীণভাবে গৃহহীন দুই লাখ ৫০ হাজার এবং অন্যান্য অতিদরিদ্র মানুষের মধ্যে যে খাবার সাহায্য দেওয়া হতো, তা স্থগিত করা হলো। এদের মধ্যে রাখাইন রাজ্যেই বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকা এক লাখ ২০ হাজার মানুষ ডব্লিউএফপির খাবারের ওপরই নির্ভর করত, যাদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা।

যারা জীবন বাঁচিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, তাদের অবস্থাও করুণ। অনেককে শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় পেলেও খাবারের তীব্র সংকটের মধ্যে রয়েছেন। অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন স্থানীয় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। অনেক রোহিঙ্গা পরিবার মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে উপকূলের পাশে বন-জঙ্গল সাফ করে বাঁশ-প্লাস্টিক দিয়ে ছাউনি তৈরির চেষ্টা করছে।

রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে পরিবার নিয়ে চার দিন আগে বাংলাদেশে এসেছেন যুবক মোহাম্মদ হোসাইন। তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে একটা ঘর তোলার চেষ্টা করছি। কিন্তু জায়গার সংকট। কিন্তু এখনো জায়গা দেখে যাচ্ছি।’

‘কিছু বেসরকারি সংস্থার লোকজন এখানে এসে আমাদের দেখে গেছে। কিন্তু কোনো খাবার আমাদের নেই। অনেক গর্ভবতী নারী খোলা আকাশের নিচে রাস্তার পাশে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। অসুস্থ শিশুদের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থাও এখানে নেই’, যোগ করেন মোহাম্মদ হোসাইন।

গত অক্টোবরের পর থেকেই বালুখালীর অনিবন্ধিত শরণার্থীর ক্যাম্প বাইরের দিকে নাটকীয়ভাবে বাড়তে শুরু করে। সেখানেই রাস্তার পাশের মাটি কেটে বাঁশ দিয়ে ঝড়-বৃষ্টি থেকে নিজেদের বাঁচার মতো ছাউনি তৈরির চেষ্টা করছেন রোহিঙ্গারা।

গত ২৪ আগস্ট রাতে রাখাইন রাজ্যে একসঙ্গে ২৪টি পুলিশ ক্যাম্প ও একটি সেনা আবাসে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। ‘বিদ্রোহী রোহিঙ্গাদের’ সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) এই হামলার দায় স্বীকার করে। এ ঘটনার পর মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী নিরস্ত্র রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুদের ওপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। সেখান থেকে পালিয়ে আসার রোহিঙ্গাদের দাবি, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নির্বাচারে গ্রামের পর গ্রামে হামলা নির্যাতন চালাচ্ছে। নারীদের ধর্ষণ করছে। গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে।

মিয়ানমার সরকারের বরাত দিয়ে জাতিসংঘ গত ১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, মিয়ানমারে সহিংসতা শুরুর পর গত এক সপ্তাহে ৪০০ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৩৭০ জন ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী’, ১৩ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, দুজন সরকারি কর্মকর্তা এবং ১৪ জন সাধারণ নাগরিক।

মিয়ানমার সরকারের আরো দাবি, ‘বিদ্রোহী সন্ত্রাসীরা’ এখন পর্যন্ত রাখাইনের প্রায় দুই হাজার ছয়শ বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। তাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য এখনো রাখাইন রাজ্যে থাকা মুসলিমদের মধ্যে মাইকে প্রচার চালাচ্ছে সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।