আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ইতিমধ্যে কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব যাচাই-বাছাই শেষ করেছে। পাইকারিতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম প্রায় ১৫ শতাংশ এবং গ্রাহক পর্যায়ে ৬ থেকে সাড়ে ১৪ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে। এই প্রস্তাবের ওপর ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে গণশুনানি শুরু হবে। বিইআরসি আইন, ২০০৩ অনুযায়ী গণশুনানির পর ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে বিইআরসি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবে। ২০১০ সালের ১ মার্চ থেকে ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় বছরে পাইকারি পর্যায়ে পাঁচবার এবং খুচরা গ্রাহক পর্যায়ে সাতবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এবার দাম বাড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, দাম বাড়ানোর বর্তমান প্রক্রিয়া অযৌক্তিক। কারণ, বিইআরসির নির্দেশনা অনুযায়ী সরকার কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথ অনুসরণ করছে না, বরং বেশি দামের তেলভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ফার্নেস তেলের দাম বাজারদর অনুযায়ী করে দিলেও উৎপাদন ব্যয় অনেকখানি কমত। তা–ও করা হচ্ছে না। পদ্ধতিগত লোকসান (সিস্টেম লস) কমিয়ে মুনাফা বাড়ানোর কার্যক্রমও যথেষ্ট সফল নয়। এগুলো করা হলে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না, বরং কমানো সম্ভব হবে। বিইআরসির সূত্র জানায়, এবার বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে পাইকারি বিক্রির ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৭২ পয়সা (প্রায় ১৫ শতাংশ) বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। আর বিভিন্ন বিতরণ কোম্পানি গ্রাহক পর্যায়ে ৬ থেকে সাড়ে ১৪ শতাংশ প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। বিতরণ কোম্পানিগুলোর দাবি, প্রতিবারই পাইকারির তুলনায় খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয়েছে কম। ফলে তাদের পক্ষে কোম্পানি চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে বিইআরসিতে উপস্থাপন করা বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বর্তমানে দেশের ছয়টি বিতরণ কোম্পানির মধ্যে একমাত্র পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) লোকসান দিচ্ছে। অন্য চারটি কোম্পানি লাভজনক। এই কোম্পানিগুলো হচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বিতরণ অঞ্চল, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি), ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ডেসকো) এবং পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ওজোপাডিকো)। এ ছাড়া উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (নওজোপাডিকো) নতুন গঠিত হয়েছে। পিডিবির রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের সম্পদ ও দায়দেনা নিয়ে গত বছরের অক্টোবরে কাজ শুরু করা এ কোম্পানি এবারই প্রথম বিইআরসির কাছে আসছে। পাইকারি দাম বাড়ানোর জন্য পিডিবির দেওয়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে সরবরাহ করতে গড়ে ব্যয় হয় ৫ টাকা ৫৯ পয়সা। কিন্তু বর্তমানে প্রতি ইউনিটের দাম নির্ধারিত আছে ৪ টাকা ৮৭ পয়সা। এখন দাম বাড়িয়ে এই ৭২ পয়সার ব্যবধান ঘোচানো দরকার। না হলে পিডিবির পক্ষে এই অর্থের সংস্থান সম্ভব নয়। গ্রাহক পর্যায়ে ডিপিডিসি ৬ দশমিক ২৪ শতাংশ, ডেসকো ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ, ওজোপাডিকো ১০ দশমিক ৩৬ শতাংশ, আরইবি ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং পিডিবি ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। এ ছাড়া দু-একটি বিতরণ কোম্পানি গ্রাহক পর্যায়ে ডিমান্ড চার্জ ও সার্ভিস চার্জ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বলে বিইআরসির সূত্র জানায়। বর্তমানে কোম্পানিভেদে প্রতিটি মিটারে প্রতি মাসে ৩০ টাকা পর্যন্ত ডিমান্ড চার্জ ও ২০ টাকা পর্যন্ত সার্ভিস চার্জ ধার্য আছে বলে জানা গেছে। লাভজনক বিতরণ কোম্পানিগুলোও যে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে, তার যৌক্তিকতা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিইআরসির সদস্য (বিদ্যুৎ) মো. মিজানুর রহমান বলেন, কোম্পানিগুলোর লাভ-লোকসানের সব তথ্যই গণশুনানিতে প্রকাশিত হবে। তার ভিত্তিতেই বিইআরসি সিদ্ধান্ত নেবে। প্রস্তাব করলেই যে দাম বাড়ানো হবে, বিষয়টি এমন নয়। তবে পিডিবির সূত্র বলেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে তেলও (ফার্নেস অয়েল) কিনতে হচ্ছে বেশি দামে। ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন মূল্য বিক্রয়মূল্যের চেয়ে বেশি পড়ছে। তাই দাম বাড়ানোর বিকল্প নেই। ক্যাব এবং বেসরকারি বিশেষজ্ঞদের মতে, দাম বাড়ানোর কার্যকর বিকল্প আছে, তা হলো বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের (ফার্নেস) দাম বাজারমূল্যে সরবরাহ করা। বর্তমান বাজারদরে ফার্নেস তেল থেকে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ছে ছয় টাকার মতো। যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে সরকার ফার্নেস তেল আমদানি করার লাইসেন্স দিয়েছে, তারা বর্তমানে এই দামে সরকারের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করছে। অন্যদিকে যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত দামে ফার্নেস তেল নিচ্ছে, তাদের উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ছে ১২ টাকার বেশি। কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারদর অনুযায়ী বর্তমানে প্রতি লিটার ফার্নেস তেলের দাম ২২ থেকে ২৪ টাকা, আর বিপিসি বিক্রি করে ৪২ টাকা।
সূত্র: প্রথম আলো।