মিয়ানমারের বুরাইঙ্গা পাড়া থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে লম্বা বিল হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেন ইয়াসমিন সুলতানা নামের এক যুবতী। পাঁচ দিন হেঁটে গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তিনি লাম্বা বিলে আসেন।
তিনি অকপটেই জানালেন, সেখানকার করুণ কাহিনী। বললেন, তার গ্রামে বৃদ্ধা ও তরুণীদের পৃথক লাইনে দাঁড় করানো হয়েছিল। সেখানে তরুণী যুবতীদের আলাদা একটি বাড়িতে নিয়ে বার্মিজ আর্মিরা গণধর্ষণ করেছে। তিনি নিজেও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তবে শুধু ধর্ষণই নয়, তার সামনেই তিন তরুণীকে গুলি করে হত্যাও করা হয়। নিজেকে অসুস্থ বলে হাতে ধরে পায়ে পড়ে কোনোমতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন ইয়াসমিন। শারীরিকভাবে দুর্বল থাকা ইয়াসমিনকে লম্বা বিলের একটি খালের কিনারে বসে থাকতে দেখা যায়। তিনি জানান, তার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এক স্বজনের জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি। শুধু ইয়াসমিনই নন, তার মতো অসংখ্য যুবতী তরুণী মিয়ানমারে বার্মিজ আর্মি ও উগ্রপন্থি বৌদ্ধদের দ্বারা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। শুধু নির্যাতনই নয়, অনেক তরুণীকে হত্যাও করা হয়েছে। চোখের সামনে বয়োবৃদ্ধ ও বৃদ্ধাদের ওপর নানাভাবে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা যুবকদের হত্যার পাশাপাশি পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। হোয়াইক্যং লম্বাবিল সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করে শিকদারপাড়ার বিধবা জয়নাব আক্তার (২২)। তিনি জানালেন, তার স্বামী ও ভাইকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা সাত দিন আগেই পুড়িয়ে হত্যা করেছে। তাকেও দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে। চার সন্তান নিয়ে ছয় দিনে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, এখন এই ছেলে সন্তান নিয়ে কোথায় যাব, কী করব? সরেজমিন লম্বাবিল ও আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত ঘুরে দেখা গেছে, রাখাইনের আকাশে হেলিকপ্টার চক্কর দেওয়ার পর ওপারের পোয়াখালী, নাইচাডং, শিকদারপাড়া, নাইছাপ্রু, হাতিপাড়া এলাকায় বাড়ি ঘরে আগুন দেওয়া হয়েছে। আগুনের লেলিহান শিখায় ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে গোটা এলাকা। বাংলাদেশে আসা একাধিক রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষ জানান, এ পর্যন্ত সহিংসতায় অন্তত ৫ হাজার যুবতী নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তাদের অনেককেই নির্মমভাবে মেরে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া ১০ হাজার যুবককে গুলি করে ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। তবে জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী সহস াধিক যুবককে হত্যা করা হয়েছে রাখাইন রাজ্যে। দলে দলে ছুটে আসা রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইন রাজ্যে নতুন করে শুরু হওয়া সহিংসতা তীব্র আকার ধারণ করেছে। গতকাল পর্যন্ত একই চিত্র লক্ষ্য করা যায়। মিয়ানমারের পোয়াখালী এলাকার হাবিবুল্লাহ (৫০) বলেন, তার ছেলে এরফানকে (৫) হত্যার উদ্দেশে পাহাড় থেকে নিচে নিক্ষেপ করে ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও তার কোমর ভেঙে গেছে। মিয়ানমারের ঢেঁকিবুনিয়া এলাকার জয়নাল আবেদীন (৩৩) বলেন, অতর্কিত অবস্থায় তাদের বাড়িঘর লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে স্ত্রী ছৈয়দা খাতুন (২৯), ছেলে হাসান (৭), মো. ইছা (৫), মেয়ে মাহিদাকে (২) সঙ্গে নিয়ে এদেশে চলে আসেন। জলপাইতলি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে আসা ঢেঁকিবুনিয়া এলাকার বাসিন্দা লোকমান হাকিম (৫০) ও তার ভাই মো. নোমান (৪৫) বলেন— স্ত্রী, পুত্র, জায়গা-জমি, গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি ফেলে জীবন বাঁচাতে চলে এসেছে বাংলাদেশে। এদের প্রত্যেকের অভিযোগ, মিয়ানমার সেনা ও বিজিপির সদস্যরা রাখাইনে যুবক-যুবতী চিহ্নিত করে হত্যায় মেতে উঠেছে। বয়োবৃদ্ধদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে বলে তাদের অভিযোগ।
সন্তান জন্ম দিলেন হাসিনা বেগম : মিয়ানমারের টম বাজার এলাকা থেকে ছয় দিন হেঁটে গতকাল উখিয়ার আঞ্জুমানপাড়া বিলে আশ্রয় নেন হাসিনা বেগম নামে এক রোহিঙ্গা গর্ভবতী নারী। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে খোলা আকাশের নিচে জন্ম দিলেন এক ছেলে সন্তান। এ সময় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। ছিল না কোনো তাঁবু। প্রসব বেদনায় যখন কাতরাচ্ছিলেন, তখন তার পাশে তেমন কেউ ছিল না। স্বামীর সহযোগিতায় ফুটফুটে এক বাচ্চার জন্ম দেন হাসিনা বেগম। বেলা ১টার দিকে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানালেন, সুস্থ আছেন। তবে ক্ষুধার্থ। এ নিয়ে তার পাঁচ সন্তান। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এসেও সুস্থ বাচ্চা জন্ম দেওয়ায় চরম খুশিও তিনি। বাচ্চার নাম কী রাখবেন, জানতে চাইলে বাবা নাসির মোহাম্মদ বলেন, জিহাদ হোসেন। জিহাদ কেন নাম এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অনেক যুুদ্ধ করে স্ত্রী ও চার সন্তানকে নিয়ে বাংলাদেশে তিনি পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন। তাই বাচ্চার নাম জিহাদ হোসেন রাখা হয়েছে।