জাতীয়

এবার জাতিসংঘকে জানানো হচ্ছে সাতক্ষীরার মুক্তামনির গল্প

By Daily Satkhira

September 11, 2017

ডেস্ক রিপোর্ট : এবার জাতিংঘকে জানানো হচ্ছে সাতক্ষীরার বিরল রোগে আক্রান্ত মুক্তামণির চিকিৎসায় সাফল্যের কথা। জানানো হচ্ছে তোহা-তহুরাকে সফলভাবে আলাদা করার গল্পও।

আগে ছিল তোফা-তহুরা, এখন তারা তোফা ও তহুরা। আগে ছিল এক শরীর, এখন পৃথক। আগে একজন আরেকজনকে দেখতে পেত না, এখন একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে, হাত দিয়ে মুখে চিমটি কাটে। তোফা ও তহুরা আজ বাড়ি ফিরছে, আর তাতে হাসি ফুটেছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকসহ প্রতিটি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মুখে। তোফা ও তহুরার সুস্থ হয়ে বাড়ি যাওয়াতে তারা সবাই খুশি। কেবল তাই নয়, জানা গেল, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে বাংলাদেশের যে প্রতিনিধি দল অংশ নেবেন তারা সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের কিছু সাফল্যের গল্প, যে সাফল্যের মুকুটে পালক যোগ করেছে বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবা, যেখানে ঠাঁই পেয়েছে তোফা ও তহুরা এবং মুক্তামনির চিকিৎসার সফলতার কথা।

আজ ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে বিদায় দেওয়া হয় দেশের প্রথম ‘পাইগোপ্যাগাস শিশু’ তোফা ও তহুরাকে। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়ার অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ এ তথ্য দেন। তিনি বলেন, তোফা ও তহুরা এবং মুক্তামনির সফল অপারেশনের খবর জাতিসংঘে যাচ্ছে বইয়ের পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ হয়ে। স্বাস্থ্য খাতের সফলতা নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে একটি বই তৈরি করেছি, যে বইটি জাতিসংঘের অধিবেশনে আসা প্রতিটি দেশের প্রতিনিধি দলকে বিতরণ করা হবে।সেই বইয়ে মুক্তামনি এবং তোফা ও তহুরার ছবি এবং এদের চিকিৎসা করা চিকিৎসকদলের ‘সাকসেস স্টোরি’ আমরা লিপিবদ্ধ করেছি বলেন অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। দেশের প্রথম পাইগোপ্যাগাস শিশু তোফা ও তহুরা, আর রক্তনালীতে টিউমার নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল মুক্তামনি। তোফা ও তহুরার আগে বিশ্বে ১৩টি পাইগোপ্যাগাস শিশুর জন্ম হয়, যাদের ৬০ শতাংশই অপারেশন পরবর্তী জটিলতায় মারা যায়। কিন্তু প্রায় ৯ ঘণ্টার অস্ত্রোপচার শেষে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের প্রায় ২০ থেকে ২২ জনের একটি দল জোড়া লাগা শিশু তোফা-তহুরার অস্ত্রোপচার করেন।

অপরদিকে, উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠাতে চাইলেও মুক্তামনির অপারেশন করতে অস্বীকৃতি জানায় সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল। পরে বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের চিকিৎসকরা। ৩০ জন বিশিষ্ট চিকিৎসকের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও সে অনুযায়ী নেওয়া সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে মুক্তামনির হাত অক্ষুণ্ন রেখেই সফল অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়। তার হাত ও রক্তনালীতে আর কোনও টিউমার নেই বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। শিশুটি এখন হাসপাতালে নিবিড় শুশ্রূষার মধ্যে রয়েছে।

রবিবার হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, তোফা ও তহুরার মা ২৩ বছরের সাহিদার মুখ যেখানে দুইমাস আগেও ছিল বিষাদে ঘেরা, সেখানে আজ তার মুখের হাসি থামছিলই না। এক মেয়েকে পাশে রেখে আরেক মেয়েকে কোলে নিয়ে বাটি থেকে চামুচ দিয়ে ‍দুধ খাইয়ে দিচ্ছিলেন।আর কিছু সময় পরেই তারা হাসপাতাল ছাড়বেন বলে তোফা ও তহুরার বাবা রাজু মিয়া ব্যস্ত ছিলেন ব্যাগ গোছানোর কাজে। তবে এরমধ্যেই একমুখ হাসি নিয়ে তিনি বলেন, মেয়েদের নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি-ওরা সুস্থ আছে, এটাই ছিল একমাত্র চাওয়া।

পরে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া অনুষ্ঠানে তোফা ও তহুরা হাজির হয় গোলাপি রং এর জামা,ম্যাচিং করে হেয়ার ব্যান্ড, হাতে চুড়ি, কপালে কালো ছোট কালো টিপ এবং কপালের আরেক পাশে নজর কাটানো টিপ দিয়ে। তারা বাবা মায়ের কোলে বসে কখনও কাঁদছে, কখনওবা আবার হাসছে, চিকিৎসকদের সঙ্গে সেলফি তোলায় তাকিয়ে থাকছে চোখ বড় করে। ছাড়পত্র দেওয়া অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম দুজনকেই একসময় একসঙ্গে কোলে তুলে নেন। এসময় তিনি গণমাধ্যমে সংবাদটি প্রাধান্য দিয়ে প্রচার ও প্রকাশের অনুরোধ জানান। কারণ, সীমিত সম্পদের মধ্যেও চিকিৎসাসেবায় এটি বাংলাদেশের অনন্য সাফল্যের দৃষ্টান্ত যা বিশ্ববাসীকে জানানোর পাশাপাশি তরুণ চিকিৎসকদেরও উৎসাহিত করবে।

ছাড়পত্র দেওয়ার পর তোফা ও তহুরার মা সাহিদা বেগম ও বাবা রাজু মিয়া চলে যান তাদের কেবিনে, কিছু গোছগাছ যে এখনও বাকি। কেবিনে গিয়ে দেখা যায়, তোফাকে কোলে নিয়ে খাওয়াতে ব্যস্ত মা, একসঙ্গে লাগানো দুটো বেডের আরেকটিতে হামাগুড়ি দিয়ে রয়েছে তহুরা। সে কাঁদছে,খেলছে আর হাসছে। মা সাহিদা বেগম হাসতে হাসতে বলেন, ১৮ বছর বয়সে বিয়ে হয়। একটি ছেলে ছিল, ইচ্ছে ছিল মেয়ে হবে একটা। কিন্তু এই মেয়েদুটো যখন হলো তখন কেবলই আমি কেঁদেছি―এই মেয়েদের নিয়ে আমি কী করবো, কোথায় যাবো, এরা বাঁচবে কী করে? কিন্তু তারপর যা হলো আমি তার জন্য এই হাসপাতালের চিকিৎসকসহ সবার কাছে কৃতজ্ঞ।

আর তোফা ও তহুরা যার অধীনে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিল, সেই চিকিৎসক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সাহনূর ইসলাম বলেন, ‘ওদের জন্ম গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর। ওরা এখানে আসে ৭ অক্টোবর। তারপর থেকেই আমার অধীনে ছিল। আমি এই এতগুলো মাস ঠিকমতো ঘুমাইনি, রাতে ঘুম ভেঙে যেত, একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিল, ইন্টারনেট ঘাঁটতাম, দেখতাম কীভাবে কী করা যায়। এর আগে পৃথিবীতে এ ধরনের ১৩টি জোড়া শিশুর জন্ম হয়েছিল, তাদের অস্ত্রোপচার কীভাবে করেছিলেন চিকিৎসকরা সেগুলো দেখতাম,পড়তাম। অবশেষে আমরা তোফা ও তহুরাকে পৃথক করতে পেরেছি।’ তিনি বলেন, ‘আজকের দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম, কিন্তু গতকাল রাত থেকে ফাঁকা লাগছে বুকের ভেতরটা, এতোগুলো মাস ধরে দিনের অধিকাংশ সময় কাটাতাম ওদের পাশে।কাল থেকে আর সেটি হবে না।’

রোগীর জন্য আপনার এত কষ্ট হচ্ছে প্রশ্ন করলে অধ্যাপক ডা. সাহনূর বলেন, ‘ওরা আমার রোগী ছিল না, ওরা আমার মেয়ে।’