বিশ্ব গণমাধ্যমে অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে এখন আরো বেশি জায়গা করে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে তিনি বিশ্বের প্রভাবশালী সব গণমাধ্যমে প্রশংসিত হচ্ছেন। ওইসব গণমাধ্যমে তাকে মানবিক এক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। সব জায়গাতেই তার একটি কথাকে উদ্ধৃত করা হচ্ছে: আমার ১৬ কোটি মানুষকে খাওয়াতে পারলে আরো সাত লাখকেও খাওয়াতে পারবো।
মঙ্গলবার কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালংয়ে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের দেখতে গিয়ে শেখ হাসিনা তাদের সাহস এবং আশা ধরে রাখার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আশ্রয় নেয়া মানুষগুলো একদিন নিশ্চয়ই তাদের নিজদেশে ফিরতে পারবে।
মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর অভিযান ও সহিংসতায় রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে দলে দলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য নতুন অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে এরইমধ্যে দুই হাজার একর জমি বরাদ্দও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তার কক্সবাজার সফরকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থান এবং বিভিন্ন পদক্ষেপ উঠে এসেছে বিশ্ব গণমাধ্যমে।
ভারতের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখেছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে দেখা করে তাদের সহায়তা করার আশ্বাস দিয়েছেন। বলেছেন, এই সঙ্কটাপন্ন পরিস্থিতি তাকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে।
হিন্দুস্থান টাইমসও একই ধরণের শিরোনাম করে লিখেছে, শেখ হাসিনা মিয়ানমারের কাছে নিজ দেশের নাগরিকদের ফেরত নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন। যতক্ষণ সেটা না হচ্ছে ততক্ষণ রোহিঙ্গাদের সাময়িক সহায়তার নিশ্চয়তা দিয়েছেন তিনি।
নিউজ১৮ প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগের ওপর ফোকাস করে শিরোনাম করেছে। লিখেছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর মিয়ানমার বর্বরতা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানিয়েছেন। রোহিঙ্গারা যেন মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পায় সেজন্য সেখানে সেফ জোন বা নিরাপদ এলাকা তৈরি করার পরামর্শও দিয়েছেন শেখ হাসিনা।রোহিঙ্গা-শেখ হাসিনা
অন্যদিকে ফার্স্টপোস্ট বলেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে দেখা করে সাংবাদিকদের বলেছেন, তার দেশ এমন অবিচার সহ্য করবে না।
পাকিস্তানের প্রভাবশালী দৈনিক ডন লিখেছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের প্রতি বর্বর আচরণের কারণে ভর্ৎসনা করেছেন এবং তাদের ফিরিয়ে নিতে জোরালো আহ্বান জানিয়েছেন।
পাকিস্তান টুডেও একই ধরণের সংবাদ প্রকাশ করেছে।রোহিঙ্গা-শেখ হাসিনা
পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমগুলোতেও গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ হয়েছে শেখ হাসিনার খবর।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি উখিয়ায় অবস্থানকালে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারের এক মিনিট ১৫ সেকেন্ড একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মিয়ানমারের উচিত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়া। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী বা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে রোহিঙ্গা গ্রামবাসীর ওপর হামলা চালাতে দেয়া মিয়ানমার সরকারের ঠিক হয়নি।
সাক্ষাতকারে প্রধানমন্ত্রী এও বলেন, কেউ অমানবিক হলেও আমরা অমানবিক হতে পারি না। আমরা আশ্রয় নেয়া মানুষগুলোকে আবার বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারি না, কারণ আমরা মানবিক।
ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান মিয়ানমার সরকারের প্রতি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের বিষয়টি দিয়ে শিরোনাম করে সংবাদ করেছে। লিখেছে, রাখাইনে সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন শেখ হাসিনা।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্ট অন্যান্য বেশিরভাগ গণমাধ্যমের মতোই বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং তাদের সহায়তা করার আশ্বাসের বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
তবে শিরোনাম ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হলেও সংবাদ মাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনের মূল কথা একই: এক মানবিক রাষ্ট্রনায়কের প্রতিচ্ছবি।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর বহুদিন ধরে চলমান সংঘর্ষ-সহিংসতা সঙ্কট সমাধানে ২০১৬ সালের আগস্টে গঠিত হয় অ্যাডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে ওই কমিশন এক বছরের তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের প্রধান অং সান সু চির কাছে জমা দেয় চলতি বছরের ২৪ আগস্ট।
৬৩ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন জমা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই ২৪ আগস্ট দিবাগত রাতে ত্রিশটি পুলিশ ও সেনাচৌকিতে রহস্যজনক হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় নিহত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য। তারপরই হামলার জন্য রোহিঙ্গা ‘জঙ্গি’দের দায়ী করে জবাব হিসেবে সেনাবাহিনী পুরো অঞ্চলে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।
সেনাবাহিনীর ওই হামলায় এখনও পর্যন্ত প্রায় ৫শ মানুষ মারা গেছে, আর প্রাণভয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে বাংলাদেশে। নৌপথে পালিয়ে আসার পথে নৌকাডুবিতেও বাড়ছে মৃতের সংখ্যা।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন না করার উদ্দেশ্যেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এই হত্যাকাণ্ড শুরু করে।