ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি, কালিগঞ্জ : কালিগঞ্জ উপজেলার রতনপুর বাজারে চায়ের দোকানের খুটির সাথে জনসম্মুখে দড়ি দিয়ে বেধে দুই যুবককে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন ও এক বিধবা যুবতীকে শ্লীলতাহানীর অভিযোগ উঠেছে। ঘটনাটি ঘটেছে শনিবার সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে রতনপুর বাজারে বক্কারের চায়ের দোকানে। সরেজমিন ও প্রত্যক্ষ দর্শীদের বরাত মাধ্যমে জানা যায়, উপজেলার রতনপুর গ্রামের বিশ^নাথ মন্ডলের ছেলে তপন মন্ডলের (২৭) সাথে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে পাশ^বর্তী খড়িতলা গ্রামের মৃত সুধীর মন্ডলের ছেলে খোকন মন্ডলের (৪৫) ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। স্থানীয় জনতা তাৎক্ষণিক ভাবে বিষয়টি নিরসন করে দেয়। এরপর রতনপুর ইউনিয়নের কাশিশ্বরপুর গ্রামের রুস্তম গাজীর ছেলে এলাকায় দালাল হিসেবে পরিচিত শফি (৩৫) ও আয়ুব নামে একজন ব্যক্তি তাদেরকে বলেন রতনপুর ইউপি চেয়ারম্যান আশরাফুল হোসেন খোকন এসে তোদের এই বিষয়টি মিমাংসা করে দিবে এজন্য তপন মন্ডলকে সেখানে অবস্থান করতে বলে। কিছুক্ষণ পর চেয়ারম্যান ঘটনাস্থলে পৌছে কিছু জিজ্ঞাসা না করেই তপন মন্ডলকে বেধড়ক মারপিট করেন। একপর্যায়ে তাকে মারতে মারতে একটি দোকান ঘরের মধ্যে নিয়ে যান। এসময় চেয়ারম্যানের নির্দেশে স্থানীয় গ্রামপুলিশ বাবুল দোকানের ভিতরে অবস্থানরত তপন মন্ডলের শ্যালক সুদেব মন্ডল ও তপন মন্ডলকে বক্করের চায়ের দোকানের ভিতরে একটি বাঁশের খুটিতে একত্রে পিঠমোড়া করে দড়ি দিয়ে বেধে দু’জনকে আবারও মারপিট করেন। খবর পেয়ে তপন মন্ডলের বিধবা বড় বোন কল্পনা মন্ডল (৩৫) ঘটনাস্থলে গেলে চেয়ারম্যান আশরাফুল ইসলাম খোকন তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে স্পর্শ করে তাকে জনসম্মুখে শ্লীলতাহানী করেন এবং ধাক্কা মেরে দোকানের বাইরে ফেলে দেন। তপন মন্ডল ও সুদেব মন্ডলকে রতনপুর বাজারে প্রকাশ্যে জনসম্মুখে প্রায় দুই ঘন্টা দড়ি দিয়ে বেধে রাখার পর তপন মন্ডলের ভগ্নিপতি সাধন মন্ডল ও সুদেব মন্ডলের বাবা তারাপদ মন্ডল ঘটনাস্থলে যেয়ে চেয়ারম্যানের কাছে কাকুতি মিনতি করে দু’জনকে ছাড়িয়ে নেন। এসময় চেয়ারম্যান দুটি পৃথক সাদা কাগজে তপন মন্ডল, তার স্ত্রী কাকলী মন্ডল, বোন কল্পনা মন্ডল, ভগ্নিপতি সাধন মন্ডল, সুদেব মন্ডল ও তার বাবা তারাপদ মন্ডলের কাছ থেকে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। ঘটনাস্থল ত্যাগ করার পূর্বে চেয়ারম্যান আশরাফুল হোসেন খোকন হুংকার দিয়ে ভুক্তভোগীসহ উপস্থিত জনতাকে এব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করার জন্য বলেন। কেউ এ বিষয়ে মুখ খুললে এলাকা ছাড়া করা হবে বলেও জানান তিনি। চেয়ারম্যানের এ ধরণের ন্যাক্কারজনক কর্মকান্ডে প্রত্যক্ষদর্শী বাজারের লেদমিস্ত্রী শামীম হোসেন (২৬), চা দোকানদার আবু বক্কর (৪২), আকবর সরদার (৪৮)সহ আরও কয়েকজন ব্যক্তি হতবাক হয়ে যান এবং তারা এঘটনার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেন। তবে তারা চেয়ারম্যানের ভয়ে ভীত হওয়ায় এ বিষয়ে তারা মুখ খুলতে সাহস পাননি বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। এদিকে প্রকাশ্য বাজারে একজন দায়িত্বশীল চেয়ারম্যানের হাতে মধ্যযুগীয় কায়দায় যুবতীসহ তিনজনকে নির্যাতনের ঘটনা এলাকায় জানাজানি হওয়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ সর্বস্তরের মানুষের মাঝে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। অপরদিকে নির্যাতনের বিষয়টি জানতে পেরে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ কালিগঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি সাংবাদিক অধ্যাপক সনৎ কুমার গাইন, সহ-সভাপতি যথাক্রমে দুলাল চন্দ্র ঘোষ, সজল মুখার্জী, রনজিত সরকার, সাধারণ সম্পাদক ডা. মিলন কুমার ঘোষ, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অসিত সেন, রতনপুর ইউনিয়ন পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. তরুণ কুমার ঘোষ, ধলবাড়িয়া ইউনিয়ন শাখার সাধারণ সম্পাদক সুদর্শন সরদার রোববার বিকেলে রতনপুর বাজারে যেয়ে ভুক্তভোগী ব্যক্তি ও প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিবর্গের সাথে কথা বলে বিস্তারিত খোঁজখবর নেন। তারা ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হয়ে চেয়ারম্যানের কর্মকান্ডে হতবাক হন এবং তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়ে সুষ্ঠু প্রতিকার দাবি করেন। এছাড়াও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিবর্গ ও পূজা উদযাপন পরিষদের নেতৃবৃন্দের কাছে ঘটনার বর্ণনা শুনে সাতক্ষীরা-৪ আসনের এমপি এসএম জগলুল হায়দার এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ ওয়াহেদুজ্জামান তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং নিন্দা জানান। বিষয়টি জানতে চাইলে গ্রাম পুলিশ বাবুল বলেন, আমি চেয়ারম্যান সাহেবের হুকুমের দাস। চেয়ারম্যান সাহেবের নির্দেশে আমি তাদেরকে বেঁধেছিলাম, তবে আমি তাদেরকে মারধর করিনি করলে চেয়ারম্যান সাহেব করেছেন। এব্যাপারে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান আশরাফুল হোসেন খোকন বলেন, তপন মন্ডল বাজারে খোকন মন্ডলকে মারধর করায় সে আমার কাছে অভিযোগ করে। এজন্য আমি বাজারে যেয়ে তপন মন্ডল ও সুদেবকে পুলিশের কাছে দেবো বলে বেধে রেখেছিলাম। তবে তাদের আত্মীয় স্বজন ও স্থানীয় লোকজন অনুরোধ করায় তাদেরকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছি। ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) লস্কর জায়াদুল হক বলেন, ঘটনাটি আমি এলাকাবাসীর মাধ্যমে জেনেছি। এ ব্যাপারে থানায় কেউ অভিযোগ দেয়নি। থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে তিনি জানান। এ ঘটনায় স্থানীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, পূজা উদযাপন পরিষদ নেতৃবৃন্দ, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জোর দাবি উঠেছে সকল মহলের পক্ষ থেকে।