ডেস্ক রিপোর্ট: গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠ আশুলিয়ায় র্যাব-পুলিশের পৃথক চার অভিযানে নিহত ১২ জঙ্গির মধ্যে পাঁচজনের পরিচয় নিশ্চিত করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের তথ্যভাণ্ডারে সংরক্ষিত আঙুলের ছাপ মিলিয়ে ও পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে তাদের পরিচয় নিশ্চিত করা হয়। তারা হলো টাঙ্গাইলের কাগমারায় নিহত নওগাঁর আহসান হাবীব, গাজীপুরে নিহত জয়পুরহাটের আমিনুল এহসান, কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের অভিযানে নিহত রাজধানীর বংশালের ইব্রাহীম, সিরাজগঞ্জের ফরিদুল ইসলাম আকাশ ও সুনামগঞ্জের সাইফুল ইসলাম। র্যাব-পুলিশের পক্ষ থেকে বাকি সাত জনের নিহত হওয়ার আগে ও পরের ছবি প্রকাশ করে তাদের পরিচয় শনাক্তের জন্য সাধারণ মানুষের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। গত ৮ অক্টোবর সকালে গাজীপুরের জয়দেবপুরের হাড়িনালে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে একটি বাড়িতে অভিযান চালায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র্যাব)। এ সময় র্যাবের সঙ্গে গোলাগুলিতে দুই জঙ্গি নিহত হয়। প্রায় একই সময়ে হাড়িনালের পাশের পাতারটেকে আরেক জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। সেখানে মারা যায় সাত জঙ্গি। সকালে পৃথক অভিযানে টাঙ্গাইলের কাগমারায় অভিযান চালায় র্যাবের অন্য একটি দল। সেখানে মারা যায় আরও দুই জঙ্গি। সন্ধ্যায় আশুলিয়ায় র্যাবের পৃথক আরেকটি অভিযানে পালাতে গিয়ে মারা যায় আরেক জঙ্গি। র্যাব সূত্র জানায়, গাজীপুরের হাড়িনালের জঙ্গি আস্তানায় র্যাবের অভিযানে যে দুই জঙ্গি নিহত হয়েছে, তাদের একজনের পরিচয় সম্পর্কে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। তার নাম আমিনুল এহসান। তার বাবার নাম আব্দুল গাফফার মণ্ডল। গ্রামের বাড়ি জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার জিন্দারপুর ইউনিয়নের বেগুনগ্রামে। পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, গত বছরের ৪ অক্টোবর বগুড়ার পলিটেকনিক্যালে পড়তে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় সে। এরপর থেকে সে নিখোঁজ ছিল। গত বছরের ৬ অক্টোবর তার বাবা কালাই থানায় একটি জিডিও দায়ের করেছিলেন। স্বজনরা জানিয়েছেন, আমিনুলের চলাফেরা সন্দেহজনক ছিল। কিন্তু সে যে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়বে, তা কখনও কল্পনা করেননি তারা। র্যাব সূত্র জানায়, টাঙ্গাইলের কাগমারায় নিহত দুই জঙ্গির একজন আহসান হাবীব। তার বাবার নাম আলতাফ হোসেন। গ্রামের বাড়ি নওগাঁর রানীনগর উপজেলার দক্ষিণ রাজাপুর গ্রামে। পরিবারের সদস্যরা জানায়, ২০০৯ সালে নওগাঁ ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে সে। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়। ২০১৪ সালে অস্ত্রসহ একবার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। কয়েক মাস কারাগারে থাকার পর জামিনে বেরিয়ে আসে। এরপর সে আত্মগোপনে চলে যায়। পরিবারের সদস্যরা তাকে খুঁজে না পেয়ে স্থানীয় র্যাব কার্যালয়ে সহায়তা চেয়ে আবেদনও করেছিলেন। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানিয়েছেন, ‘র্যাবের অভিযানে নিহত ৫ জনের মধ্যে দুই জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। বাকি তিন জনের ছবি প্রকাশ করে তাদের পরিচয় জানাতে সাধারণ মানুষের কাছে আহ্বান জানানো হয়েছে।’
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, ‘র্যাবের অভিযানে আশুলিয়ায় পালাতে গিয়ে পাঁচ তলা থেকে পড়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিহত ব্যক্তিকে তারা প্রাথমিকভাবে আব্দুর রহমান ওরফে নাজমুল হোসেন হিসেবে শনাক্ত করেছিলেন। জব্দ করা একটি পাসপোর্টের সূত্র ধরে স্থায়ী ঠিকানা সাতক্ষীরা কুশখালীতে খোঁজও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু পাসপোর্টে দেওয়া তথ্য ভুল ছিল। পাসপোর্টটি আসল না নকল তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।’ র্যাবের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ‘আব্দুর রহমান ওরফে নাজমুল হোসেন নব্য জেএমবির অর্থের জোগানদাতা হিসেবে কাজ করতো। তার বাসা থেকে অস্ত্র-গুলি ও এক্সপ্লোসিভসহ প্রায় ৩০ লাখ টাকাও উদ্ধার করা হয়েছে। তার স্ত্রীকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। কিন্তু সেও প্রকৃত পরিচয় জানাতে পারেনি।’ র্যাবের ওই কর্মকর্তা জানান, ‘কথিত আব্দুর রহমান ওরফে নাজমুল হোসেন তার প্রকৃত পরিচয় আড়াল করে জঙ্গি কার্যক্রম চালাতো।’ এদিকে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট সূত্র জানায়, গাজীপুরের পাতারটেকে তাদের অভিযানে যে সাত জন জঙ্গি মারা গিয়েছে, তাদের মধ্যে ৩ জনের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন তারা। এর মধ্যে ফরিদুল ইসলাম আকাশ সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার গান্ধাইল ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ইতলী গ্রামের আবু সাঈদের ছেলে। ২০১৪ সালে সিরাজগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে ডিপ্লোমা ডিগ্রি নেওয়া আকাশের পুরো পরিবারই জঙ্গিকর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। গত ৫ সেপ্টেম্বরে আকাশের মা, দুই বোন এবং প্রতিবেশী এক নারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা জেএমবির আত্মঘাতী দলের সদস্য বলে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। ওই ঘটনার পর থেকে আকাশের বাবা আবু সাঈদ দুই শিশু সন্তান নিয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, ‘আকাশ ছিল নব্য জেএমবির ঢাকা বিভাগীয় কমান্ডার। সে নব্য জেএমবির মাস্টারমাইন্ড তামিমের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিল। তামিমের নির্দেশনা অনুযায়ী সে শোলাকিয়া ঈদগাহ জামাতে হামলার বিষয়টি সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিল।’ সিটি সূত্র জানায়, পাতারটেকে নিহত জঙ্গিদের আরেকজন হলো রাজধানীর বংশালের ৫৪ নম্বর পুরানো মোঘলটুলির বাসিন্দা আজিমুদ্দিনের ছেলে ইব্রাহীম। সে গাজীপুরের তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা থেকে আলিম পরীক্ষা দিয়েছিল। আলিমে তার রেজাল্ট ছিল জিপিএ ৪.৮০। কিন্তু ফল প্রকাশ হওয়ার আগেই গত ৮ আগস্ট সে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। এরপর দিন ইব্রাহীমের বাবা বংশাল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন। পাতারটেকে নিহত আরেক জঙ্গি সিলেটের ছাতক উপজেলার দক্ষিণ খুরমা ইউনিয়নের মনিরগাতি গ্রামের সাইফুল ইসলাম। তার বাবার নাম মতিউর রহমান ওরফে ময়না শাহ এবং মায়ের নাম হুসনে আরা। দুই মাস ধরে সাইফুল নিখোঁজ ছিল বলে তার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন। সাইফুল স্থানীয় পীরপুর হাইস্কুল থেকে এসএসসি ও সিলেটের রায়নগরের সার্ক ইন্টারন্যাশনাল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে কোচিং করতে ঢাকায় গিয়ে সে জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, ‘পাতারটেকে নিহত জঙ্গিদের সবার পরিচয় জানার জন্য ছবি প্রকাশ করা হয়েছিল। এর মধ্যে তিনজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। বাকিদের পরিচয় জানার চেষ্টা চলছে।’ সিটির ওই সূত্র জানায়, বাকি পাঁচজনের মধ্যে একজনকে তারা গাইবান্ধার আবু শামার ছেলে হাফেজ ছানাউল্লাহ ওরফে হুজুর বলে সন্দেহ করছেন। তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা চলছে। এছাড়া আরেকজনের সাংগঠনিক নাম ‘মেকানিক’ বলেও জানতে পেরেছেন তারা। তবে তার পরিবারের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এদিকে, ফেসবুকে তিন জঙ্গির ছবি প্রকাশ করে র্যাব লিখেছে, ‘আপনারা জানেন, গত ৮ অক্টোবর শনিবার গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও আশুলিয়ায় র্যাবের পৃথক জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হওয়া ৫ জঙ্গির মধ্যে ২ জনের পরিচয় আমরা নিশ্চিত হয়েছে। নিচের ছবির ৩ জঙ্গির পরিচয় জানা জায়নি। এসব জঙ্গির পরিচয় জানতে আপনাদের আশেপাশে অতীতে অবস্থান করছিল, এমন কোনও ব্যক্তির সঙ্গে যদি ছবিগুলো মিলে যায় অথবা ছবিগুলো আপনার পরিচিত মনে হয়, তাহলে শিগগিরই আপনার নিকটস্থ র্যাব ক্যাম্প অথবা র্যাব সদর দফতরে যোগাযোগ করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হল। বিশেষ প্রয়োজনে +৮৮০১৭৭৭৭২০০৭৫ নম্বরের মোবাইলফোনে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানায় র্যাব।